মান নিশ্চিত করলেও দামে প্রতিযোগী হতে পারছি না

সেলিম এইচ রহমান: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হাতিল
সেলিম এইচ রহমান: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হাতিল
>

ঢাকায় পাঁচ দিনের জাতীয় ফার্নিচার মেলা আজ শনিবার শেষ হচ্ছে। মেলার উদ্বোধনের দিন আসবাবশিল্পের সম্ভাবনা, অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি বাজারসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান ও আসবাবের ব্র্যান্ড হাতিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার।

প্রথম আলো: গত শতাব্দীতে দেশে ব্র্যান্ড আসবাবের নেতৃত্ব দিয়েছে অটবি, হাতিল, আকতারসহ হাতে গোনা কয়েকটি ব্র্যান্ড। তবে গত ১৯ বছরে বেশ কয়েকটি নতুন ব্র্যান্ড বাজারে এসেছে। সামগ্রিকভাবে ব্র্যান্ডের আসবাবের ব্যবসা কেমন?

সেলিম এইচ রহমান: ব্র্যান্ডের আসবাবের ব্যবসা ভালো। কারণ, ব্র্যান্ড হচ্ছে আস্থা ও বিশ্বাসের নাম। ক্রেতারা আসবাব কেনার পর প্রত্যাশা করেন পণ্যের পরবর্তী দায়দায়িত্ব বিক্রেতা নেবেন। সেটি কেবল একটি ব্র্যান্ডের পক্ষেই সম্ভব। ব্র্যান্ডের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে। ব্র্যান্ডগুলো প্রতিনিয়ত তাদের পণ্যের মান ও নকশার উন্নতির জন্য গবেষণা করছে। ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে পণ্য কীভাবে নিয়ে আসা যায়, সে বিষয়ে কাজ করছে ব্র্যান্ডগুলো।

প্রথম আলো: ব্র্যান্ডের আসবাবের বিষয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগ, দাম বেশি। বিষয়টি নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?

সেলিম এইচ রহমান: দামের বিষয়টি একটি পারসেপশনের ব্যাপার। আপনি যদি হাতিলের পণ্যের সঙ্গে নন–ব্র্যান্ডের পণ্যের তুলনা করেন, তাহলে দেখবেন, আমাদের পণ্যের দাম কম। কেন কম? প্রথম কথা হলো ব্র্যান্ড প্রতিনিয়ত গবেষণা করে পণ্যের মান উন্নয়ন করে। যেখানে যে কাঁচামালটি দরকার, সেটিই ব্যবহার করে। সেগুন ও কড়ই—দুটিই কাঠ, তবে দামের তফাত অনেক। ব্র্যান্ডগুলো ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রক্রিয়ায় আসবাব প্রস্তুত করে থাকে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রক্রিয়ায় কখনো দাম বাড়ে না, উল্টো কমে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে আসবাব কিনতে গেলে আমরা শুধু দামটাই দেখি। বাকি বিষয়গুলো দেখি না। ফলে আমরা প্রতারিত হই। তবে ব্র্যান্ডের পণ্য কেনার সময় মানুষ ভাবে, দাম সামান্য বেশি হলেও তিনি প্রতারিত হবেন না। কারণ, ব্র্যান্ড সেই পণ্যের দায়দায়িত্ব নেবে।

প্রথম আলো: ব্র্যান্ডের ফার্নিচারের অধিকাংশ কাঁচামালই তো আমদানি করতে হয়। আমদানি শুল্ক হ্রাস করলে কি পণ্যের দাম কমবে?

সেলিম এইচ রহমান: অবশ্যই দাম কমবে। আমরা যখন ১০০ টাকার কাঁচামাল আমদানি করি, তখন শুল্কের কারণে তা গিয়ে ১৫৫-১৬০ টাকায় ঠেকে। এখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। কাঠের আমদানি শুল্ক কম। এটি নিয়ে প্রশ্ন নেই। আসলে আসবাবের জন্য কাঠ ছাড়াও অনেক উপাদান লাগে। একটি চেয়ার তৈরিতে যে টাকার কাঠ লাগে, সেই একই পরিমাণ অর্থ ফিনিশিংয়ে ব্যয় করতে হয়। ড্রয়ারের স্লাইড, লকসহ অন্যান্য সরঞ্জামের আমদানি শুল্ক ৫৫-৬০ শতাংশ। আবার ফেব্রিকের আমদানি শুল্ক ১০৪ শতাংশ। বাংলাদেশে আসবাবশিল্পের সম্ভাবনা অনেক। তাই সরকার আসবাবের কাঁচামালের শুল্ক কমানোর চিন্তাভাবনা করতে পারে।

প্রথম আলো: ব্র্যান্ডের আসবাবের বাজার কত বড় হলো? নতুন বিনিয়োগের কি সুযোগ আছে?

সেলিম এইচ রহমান: দেশে আসবাবের বাজার বর্তমানে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার কোটি টাকার মতো। আমাদের ধারণা, ব্র্যান্ড ছয় ভাগের এক ভাগ ব্যবসা নিতে পেরেছে। বর্তমানে ১২-১৫টি ব্র্যান্ড আছে। জেলা শহর পর্যন্ত ব্র্যান্ডগুলো পৌঁছাতে পেরেছে। ব্যবসার পরিধি বাড়াতে হলে অর্থাৎ উপজেলা পর্যায়ে যেতে হলে গবেষণা করে পণ্যের দাম কমাতে হবে। আমরা সেই কাজটি শুরু করেছি। আমরা একটি খাট তৈরি করেছি, যার দাম ১৬ হাজার টাকা। সে ক্ষেত্রে পণ্যের নকশা ও মানের কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। দেশের বাজারে আরও ব্র্যান্ড আসার সুযোগ আছে। কারণ, একটা সময় আসবে, ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানকে প্রক্রিয়াগত উৎকর্ষে যেতে হবে অথবা ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রি করতে হবে। তা ছাড়া আসবাব রপ্তানির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে বড় বিনিয়োগ দরকার। তবে তা সঠিক প্রক্রিয়ায় আসতে হবে।

প্রথম আলো: আসবাবের নন–ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় কাঠের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু দেশের বনসম্পদ তো সীমিত। সে ক্ষেত্রে আসবাবশিল্পের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় কী করণীয়?

সেলিম এইচ রহমান: ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় কাঠ ব্যবহার করে। তাদের পণ্যের নকশায় দেখবেন মোটা মোটা কাঠ ব্যবহার করা হয়। নকশায় নতুনত্ব নেই। তারা অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় উপাদান ব্যবহার করে। সেই হিসেবে বিপুল পরিমাণ কাঠের অপচয় হয়। এটি কিন্তু রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। এ অপচয় বন্ধ করার জন্য আসবাবের নকশা ও কারিগরি দিক উন্নতির জন্য একটি ইনস্টিটিউট করা দরকার। অন্যদিকে বনসম্পদ রক্ষায় কাঠের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করা দরকার। অন্তত ৫-১০ বছরের জন্য হলেও কাঠ আমদানিকে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে দেশীয় কাঠের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমবে। বনসম্পদ বাড়বে।

 প্রথম আলো: দেশে অনেক ব্র্যান্ড হওয়ার পরও চীন থেকে প্রচুর পরিমাণে আসবাব আমদানি হচ্ছে। বিশেষ করে অফিস ফার্নিচার। কারণ কী?

সেলিম এইচ রহমান: বাসাবাড়ির আসবাবের মধ্যে কাঠের একটি আধিক্য থাকে। কিন্তু অফিস ফার্নিচারে কারিগরি অনেক বিষয় আছে। আমরাও অফিস ফার্নিচার তৈরি করি, তবে তার অনেক কিছুই আমদানি করতে হয়। আরেকটা বিষয় হলো দেশে আরও অনেক ব্র্যান্ড যখন বাজারে একই মানের পণ্য নিয়ে আসবে, তখন আমদানি কমে যাবে। তবে বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে অফিসের আসবাব আমদানিও হচ্ছে। এটিও সত্য।

প্রথম আলো: বিদায়ী অর্থবছরে সাড়ে সাত কোটি ডলারের আসবাব রপ্তানি হয়েছে। সম্ভাবনা থাকার পরও রপ্তানির পরিমাণ কেন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ছে না?

সেলিম এইচ রহমান: আসবাব রপ্তানির ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। রপ্তানিতে যেতে হলে পণ্যের গুণগত মান ও দাম—দুটি বিষয়ই নিশ্চিত করতে হবে। তবে গুণগত মান নিশ্চিত করতে পারলেও আমরা দামে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করতে পারছি না। কারণ, আমাদের অনেক কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে। আমদানি পর্যায়ে যে পরিমাণ শুল্ক দিতে হয়, তার বিপরীতে সরকার যে ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়, সেটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমাদের দাবি হচ্ছে, আমদানি শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা অথবা বন্ড সুবিধা দেওয়া অথবা নগদ সহায়তা ১৫ থেকে বৃদ্ধি করে ২৫ শতাংশ করা। যেকোনো একটি কাজ করা গেলেই আসবাবের রপ্তানি বাড়বে।

প্রথম আলো: আসবাব রপ্তানির সম্ভাবনা কেমন?

সেলিম এইচ রহমান: ইউরোপের বাজারে আমাদের সুযোগ আছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসবাব আমদানিকারক দেশ। তা ছাড়া চীন থেকে প্রচুর পরিমাণে আসবাব আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে অনেক মার্কিন ক্রেতাই চীন ছাড়তে চাইছেন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে। সব মিলিয়ে আমাদের আসবাব রপ্তানির ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রথম আলো: হাতিলের ব্যবসা কেমন চলছে?

সেলিম এইচ রহমান: ভালো। কত অল্প সময়ে সঠিক দামে পণ্য প্রস্তুত করা যায়, সেটি নিয়ে আমরা সব সময় কাজ করছি। সে জন্য আমরা ভালো আছি। আমাদের আসবাব রপ্তানি বাড়ছে। ভারতে হাতিলের ১৩টি ফ্র্যাঞ্চাইজি আছে। শিগগিরই আরও ৫টি চালু হবে। তা ছাড়া নেপালে ২টি, ভুটানে ১টি ও কানাডায় ১টি ফ্র্যাঞ্চাইজি আছে। হাতিলের কারখানা আধুনিকায়ন করা হয়েছে। সেই কারখানা সম্পূর্ণভাবে ডাস্টমুক্ত।তা ছাড়া আসবাব তৈরির সময় বের হওয়া টুকরা কাঠসহ অন্যান্য উপকরণ পুনরায় ব্যবহারের উপযোগীও করা হচ্ছে।