সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে। তখন উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার গৌরবের বিপরীতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা থাকবে না। তাতে রপ্তানি আয় ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি খুবই নড়বড়ে।
এলডিসির তালিকা থেকে বের হলে বাড়তি শুল্কের চাপে পড়ে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি কতটা কমবে, তা নিয়ে নানা মত আছে। গত বছর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ ১২ গন্তব্যদেশের ৭০ শতাংশ রপ্তানি বর্তমানে বাণিজ্যসুবিধার অধীনে হচ্ছে। সেই সুবিধা না থাকলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ৫৩৭ কোটি ডলার বা ৪৫ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা কমতে পারে। অবশ্য বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গতকাল বলেছে, রপ্তানি আয় ৮-১০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বছরে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার বা ২১ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ রপ্তানি আয় কমবে।
জানতে চাইলে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হাতে পাঁচ বছর সময় আছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে কোন রপ্তানি খাতে কী ধরনের অভিঘাত আসবে, সে অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করে আমাদের এগোতে হবে। যাতে আমরা প্রস্তুত হয়ে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করতে পারি।’ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে একটি দর–কষাকষি সেল করতে পরামর্শ দেন তিনি।
‘আমাদের হাতে পাঁচ বছর সময় আছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে কোন রপ্তানি খাতে কী ধরনের অভিঘাত আসবে, সে অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করে আমাদের এগোতে হবে। যাতে আমরা প্রস্তুত হয়ে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করতে পারি।’মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডির বিশেষ ফেলো
বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে ১ হাজার ৮৬৯ কোটি ডলারের গন্তব্য ছিল ইইউ। অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা বা জিএসপির কল্যাণে বর্তমানে বাজারটিতে কোনো শুল্ক না দিয়েই প্রবেশ করতে পারে বাংলাদেশি পণ্য। এ ছাড়া এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, জাপান, তুরস্ক ও কানাডা শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। এর বাইরে রাশিয়া ও বেলারুশ ৭১টি পণ্যে তাদের জিএসপির আওতায় বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করছে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া প্রেফারেন্সিয়াল ট্যারিফ ফর লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিজের আওতায় ৪ হাজার ৮২০টি পণ্যে সব স্বল্পোন্নত দেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করেছে। একইভাবে ৮ হাজার ২৫৬ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে চীন।
এলডিসি থেকে উত্তরণের পরপর ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যসুবিধাগুলো হারাবে বাংলাদেশ। ইইউতে বাড়তি তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা থাকবে। তারপর জিএসপি প্লাসের অন্তর্ভুক্ত হতে না পারলে বাজারটিতে প্রবেশে বাংলাদেশের শীর্ষ ১২ পণ্য (পোশাক ও জুতা) রপ্তানিতে প্রায় ১০ শতাংশ হারে শুল্ক দিতে হবে। তাতে কেবল ইইউতেই ৫২৮ কোটি ডলারের রপ্তানি কমে যেতে পারে। তার মধ্যে তৈরি পোশাকই ৪৮৫ কোটি ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যা ৪১ হাজার ২২৫ কোটি টাকার সমান। আবার ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে ইইউর সঙ্গে এফটিএ করতে সক্ষম হওয়ায় বাজারটিতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের তীব্র প্রতিযোগিতায় পড়তে হবে।
‘উন্নয়নশীল দেশ হতে পারাটা গর্বের। তবে রপ্তানি নিয়ে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছি। আমাদের প্রস্তুতি খুবই নড়বড়ে।মোহাম্মদ হাতেম, নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি
শীর্ষ রপ্তানিকারক হিসেবে তৈরি পোশাক খাতই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশ হতে পারাটা গর্বের। তবে রপ্তানি নিয়ে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছি। আমাদের প্রস্তুতি খুবই নড়বড়ে।’ তিনি বলেন, ‘ইইউতে জিএসপি প্লাস পাওয়া অনেক কিন্তুর ওপর নির্ভর করছে। বন্ধুরাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে এফটিএ করতে পারিনি। তাই দক্ষতার সঙ্গে প্রস্তুতি নিতে না পারলে অনেক মূল্য দিতে হবে।’
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে ইইউ ছাড়াও কানাডা, জাপান, কোরিয়া, চীন ও নিউজিল্যান্ডের রপ্তানি বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, তখন শুল্কমুক্ত সুবিধা বলবৎ থাকবে না। উন্নয়নশীল দেশ হলে কানাডায় বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শীর্ষ ১২ পণ্যের ১০টির ক্ষেত্রেই ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ শুল্ক ও কর দিতে হবে। এ ছাড়া জাপানে ৮-১১ শতাংশ ও কোরিয়ায় ৪-১২ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি করতে হবে।
ডব্লিউটিওর হিসাব অনুযায়ী, এলডিসির থেকে উত্তরণ হলে বাংলাদেশে ৪৮৪ কোটি ডলারের পোশাক, ১৮ কোটি ডলারের বস্ত্র, ১৬ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ১১ কোটি ডলারের মাছ ও হিমায়িত খাদ্য রপ্তানি কমে যেতে পারে।
জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন বছর আগে থেকেই এফটিএর আলোচনা শুরু করতে বলে আসছি আমরা। সেটি এখন কেবল শুরু হচ্ছে।’ এফটিএর দর–কষাকষির পাশাপাশি করব্যবস্থা সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ব্যবসার মার্জিন কমে আসছে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে সেটি আরও কমবে। তাই ব্যবসার খরচ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে কার্যকর উদ্যোগ এখনই নিতে হবে।