বাজে কোম্পানি বাজারে আনা বন্ধ করতে হবে
>নতুন বছরটির শুরুটাও ভালো হয়নি শেয়ারবাজারে। প্রায় এক বছর ধরে শেয়ারবাজারে চরম মন্দাভাব। শেয়ারবাজারের প্রধান সূচকটি নেমে এসেছে ৪ হাজার ২০০ পয়েন্টের নিচে। তাতে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন অনেক বিনিয়োগকারী। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ চান বিনিয়োগকারীরা। শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বিনিয়োগকারী আনোয়ারুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজয় মহাজন।
প্রথম আলো: কত দিন ধরে শেয়ারবাজারে ব্যবসা করছেন? শেয়ারবাজারে কেমন?
আনোয়ারুল ইসলাম: দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে শেয়ারবাজারের সঙ্গে যুক্ত। নিয়মিত লেনদেনের চেয়ে আমি একটু দীর্ঘ মেয়াদে এ বাজারে বিনিয়োগ করি। নিজের বিনিয়োগের পাশাপাশি শেয়ারের বিপরীতে ঋণসুবিধা (মার্জিন লোন) নিয়ে এ ব্যবসা করি। যেহেতু আমি ঋণসুবিধা নিই তাই আমার পত্রকোষে (পোর্টফোলিও) কোনো দুর্বল বা ‘জেড’ শ্রেণির শেয়ার নেই। আমার পত্রকোষের সিংহভাগই ভালো মৌল ভিত্তির শেয়ার। তারপরও সাম্প্রতিক দরপতনে বিপুল পরিমাণ পুঁজি হারিয়েছি। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে আগে দরপতনে জোর করে বিক্রির বা ফোর্সড সেলের আওতায় পড়ে সব পুঁজি খুইয়েছিলাম। ২০১৯ সালে নতুন আশায় বাজারে নতুন করে বিনিয়োগ করি। এখন সেই বিনিয়োগের বিপরীতে বিপুল লোকসানে আছি।
প্রথম আলো: ২০১৮ সালে জোর করে বিক্রির কারণে সব পুঁজি হারালেন। এরপর আবারও বিনিয়োগে আগ্রহী হলেন কেন?
আনোয়ারুল ইসলাম: ভাবলাম হয়তো এবার বাজার ঘুরে দাঁড়াবে। ২০১৯ সালের শুরুটাও ছিল আশা-জাগানিয়া। তাই নতুন আশায় নতুন করে আবার বাজারে বিনিয়োগ করি। গত বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, বিনিয়োগ করে কেউ ঠকবে না। অবশ্যই লাভ পাবেন। সেই আশ্বাসে ভরসা রেখে আরও কিছু অর্থ বিনিয়োগ করেছিলাম। ভেবেছি তিনি শেয়ারবাজার সম্পর্কে জানেন, বোঝেন ভালো। বাজার ভালো করতে তিনি সব ধরনের উদ্যোগ নেবেন। অথচ ২০১৯ সালের পুরোটা সময় বাজারে দরপতন ঘটেছে। তাতে আমার পুঁজি প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। এখন না পারছি লোকসান মেনে সব শেয়ার বিক্রি করে দিতে। আবার বাজার নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতোও কিছুই দেখছি না।
প্রথম আলো: আপনি তো অনেক দিন ধরেই শেয়ারবাজারে যুক্ত। এই যে এক বছর ধরে দরপতন চলছে, এর কারণ কী বলে মনে করেন আপনি?
আনোয়ারুল ইসলাম: বাজারের খারাপ অবস্থার জন্য আমার কাছে কয়েকটি কারণকে বড় মনে হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থা নেই। এ আস্থাহীনতার কারণে নতুন করে কেউই বাজারে বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না। আগে দেখেছি, দেশের বিনিয়োগকারীরা যখন বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন তখন বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ত। পরে তাদের দেখাদেখি স্থানীয়রাও একটু একটু করে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতেন। এবার দেখলাম সারা বছর বিদেশি বিনিয়োগ খালি কমছে। তাতে আমরা বাজার নিয়ে আরও বেশি আস্থাহীনতায় ভুগছি। এ ছাড়া বাজারে চাহিদা না থাকার পরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা একের পর এক নতুন আইপিওর অনুমোদন দিয়েছে। আইপিওতে আসা বেশির ভাগ কোম্পানিই খুবই বাজে মানের। এ কারণে তালিকাভুক্তির পর কিছুদিন না যেতেই এসব কোম্পানির আয় কমতে দেখি। অনেকগুলোর দাম অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে। কিছু কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয় না। তাহলে এসব কোম্পানিকে কী দেখে অনুমোদন দিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কোম্পানিগুলো বাজার থেকে টাকা লুটপাট করে নিয়ে গেছে। যার প্রভাব সেকেন্ডারি মার্কেটে পড়েছে। আর আমরা তার ভুক্তভোগী। পতনের জন্য আরেকটি কারণ মনে হয় আমার কাছে। সেটি হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতা। আমার মনে হয় এক সংস্থার পদক্ষেপ সম্পর্কে অন্য সংস্থা কিছু জানে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শেয়ারবাজারে।
প্রথম আলো: আইপিও বন্ধ করা কি সমস্যার সমাধান?
আনোয়ারুল ইসলাম: যেসব কোম্পানি দিয়ে বাজারের কোনো উপকার হবে না সেসব কোম্পানির আইপিও বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। আমার মতো অনেক বিনিয়োগকারী চান, গ্রামীণফোনের মতো ভালো ভালো কোম্পানি বাজারে আসুক। ইউনিলিভারকে বাজারে আনা হোক। ওই সব কোম্পানির মান ভালো। এতে নতুন অনেক বিনিয়োগ আসবে বলে মনে করি।
প্রথম আলো: কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে বাজার ভালো হবে বলে আপনি মনে করেন?
আনোয়ারুল ইসলাম: সবার আগে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো জরুরি। বাজে কোম্পানি বাজারে আনা বন্ধ করতে হবে। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যে নিবিড় সমন্বয় দরকার। শুধু নিজেরা নিজেরা সমন্বয়ের কথা বললে হবে না। আমরা বিনিয়োগকারীরা যাতে বুঝতে পারি সরকারের সব সংস্থা শেয়ারবাজারের উন্নয়নে আন্তরিক, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া বাজারে বিনিয়োগ বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। একসময় আমরা আইসিবিকে লেনদেনের শীর্ষে দেখতাম। অথচ এখন প্রতিষ্ঠানটি অনেক পেছনে। সরকারি প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ না বাড়লে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভরসা পাবেন কেমনে? শেয়ারবাজারের কোম্পানিগুলো তাদের যেসব আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করে সেগুলোর প্রতিও বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। কারণ কোম্পানিগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য দেয়। তাই আমি মনে করি কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন প্রতিবছর বিএসইসির পক্ষ থেকে ভালো মানের নিরীক্ষক দিয়ে পুনর্নিরীক্ষা করানো উচিত। তাহলে আমরা সঠিক চিত্র জানতে পারব।