২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাংলাদেশ: যেখানে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গী উচ্চ দুর্নীতি

প্রতিটি নতুন বছরের শুরুতে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্ট বিশেষ একটি সংখ্যা বের করে। মূলত নতুন বছরের নানা সম্ভাবনার কথাই বলা হয় এখানে। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০২০’ নামের এবারের সংখ্যায় মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা শীর্ষ যে ১০টি দেশের তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ আছে ৩ নম্বরে। ম্যাগাজিনটি বলছে, নতুন বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। শীর্ষ দশের এই তালিকা থেকে চীন বাদ পড়েছে, আর ভারত কোনোরকমে টিকে গেছে। তারা আছে ঠিক ১০ নম্বরে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) নিয়মিতভাবে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সর্বশেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ বলেছে, ২০১৯ সালে বিশ্ব জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রায় ৮৬ শতাংশ এসেছে যে ২০টি দেশ থেকে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি।

পারভেজ হুদভয়ে। ছবি :ইউটিউব
পারভেজ হুদভয়ে। ছবি :ইউটিউব

পারভেজ হুদভয় পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। তিনি সম্প্রতি ডন পত্রিকায় লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ কোনো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ভূস্বর্গ নয়। দেশটি দরিদ্র এবং জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ। এখনো শিক্ষার হার কম ও দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রায়ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়, মাঝেমধ্যে সন্ত্রাসবাদও প্রত্যক্ষ করে। আবার প্রহসনমূলক গণতন্ত্রের চেহারাও ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ লাইফ সাপোর্টে বা মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছে বলে আগে যেমনটা বলা হতো, সেই চিত্র এখন বদলে গেছে। আজকে অনেক অর্থনীতিবিদ বলছেন, এই দেশটিই হবে পরবর্তী এশিয়ান টাইগার।’

বাংলাদেশের এই ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতির উল্টো পিঠে লুকিয়ে আছে আরেক বিস্ময়। সুশাসনের সংকট, ঘুষ-দুর্নীতি, পরিবেশগত নানা বিপর্যয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাব—এসব ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী যত সূচকই প্রকাশ পায়, প্রায় সব কটিতেই অনেক অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। একদিকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, আরেক দিকে উচ্চ দুর্নীতি। বিস্ময় এখানেই। যেমন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১৯-এ এবার বাংলাদেশের উন্নতি মাত্র এক ধাপ। ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬৬তম। ট্রেস ইন্টারন্যাশনাল নামের আরেকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তৈরি বিশ্ব ঘুষ সূচকে বাংলাদেশ ২০০ দেশের মধ্যে ১৮২তম।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) নিয়মিতভাবে গণতন্ত্র সূচক প্রকাশ করে। তাদের তালিকায় বাংলাদেশ আছে ‘হাইব্রিড রেজিম’ অবস্থানে। এটি হচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক ও ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থার মাঝামাঝি অবস্থান। আর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) গত অক্টোবর মাসে প্রকাশ করেছে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবার দুই ধাপ পিছিয়ে ১৪১টি দেশের মধ্যে হয়েছে ১০৫তম। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার প্রশ্নেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের সর্বশেষ প্রকাশিত ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচক ২০১৮’-এ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম।

সর্বশেষ ১১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি) আইনের শাসন সূচক প্রতিবেদন-২০২০ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সূচকেও বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে। বিশ্বের ১২৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫তম। এক বছর আগেও বাংলাদেশ ১২৬টি দেশের মধ্যে ছিল ১১২তম।

এক বাংলাদেশের এ দুই চেহারার কারণেই এখন দেশটিকে কেউ বলছেন ‘সারপ্রাইজ’ বা বিস্ময়, ‘কেউবা বলেন ‘মিস্ট্রি’ বা রহস্য অথবা প্রহেলিকা, আবার অনেকে বলেন ‘প্যারাডক্স’ বা আপাতবৈপরীত্য। সুশাসনের বড় ধরনের সংকট, আইনের শাসনের অভাব ও ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির মধ্যে থেকেও বাংলাদেশের এই সাফল্যের রহস্য কী?

হেনরি কিসিঞ্জার । রয়টার্স ফাইল ছবি
হেনরি কিসিঞ্জার । রয়টার্স ফাইল ছবি

কেমন ছিল বাংলাদেশ
বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে মার্কিন প্রশাসন সন্দেহ প্রকাশ করেছিল স্বাধীনতা পাওয়ার আগেই। ১৯৭১ সালেই সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব হেনরি কিসিঞ্জারসহ মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বা ‘বাস্কেট কেস’ বলেছিলেন। দীর্ঘ বছর ধরে এই অপবাদ বাংলাদেশকে শুনতে হয়েছে।

আর স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রথম রিপোর্ট করেছিল ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। সেখানে বলা হয়, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। এখানকার মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র, মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলারের মধ্যে, যা গত ২০ বছরে বাড়েনি, জনসংখ্যার প্রবল আধিক্য এখানে, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ৪০০ মানুষ বাস করে, তাদের জীবনের আয়ুষ্কাল অনেক কম, এখনো তা ৫০ বছরের নিচে, বেকারত্বের হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে এবং জনসংখ্যার বড় অংশই অশিক্ষিত।’

তবে নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড এবং মার্কিন অর্থনীতিবিদ জে আর পার্কিনসন ১৯৭৬ সালে লন্ডন থেকে ‘বাংলাদেশ দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ নামে একটি বই বের করে আরও কঠিন করে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নয়নের একটি পরীক্ষাক্ষেত্র। বাংলাদেশ যদি তার উন্নয়ন সমস্যার সমাধান করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে যেকোনো দেশই উন্নতি করতে পারবে।’

এখনকার বাংলাদেশ
আয়তনের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩তম। বাংলাদেশের আয়তন বিশ্বের মোট আয়তনের দশমিক ১ শতাংশের কম। আবার এই দেশই জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে অষ্টম। আয়তন ক্ষুদ্র হলেও জিডিপির পরিমাণের দিক থেকে বিশ্বের ৪১তম দেশ বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিক রিসার্চ (সিবিইআর) অনুযায়ী, এশিয়ার ৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৬তম, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই বাংলাদেশ। একটি দেশের অর্থনীতি কতটা শক্তিশালী তা দেখার আরেক উপায় হচ্ছে ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) ভিত্তি। এটি ধরলে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩১তম বড় অর্থনীতি।

আবার চাল উৎপাদন ও গ্রহণে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ। সব ধরনের খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ১১তম, মোট ফল উৎপাদনে ২৮তম, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং চা উৎপাদনে দশম। আর ‘মাছে ভাতে বাঙালি’র এই দেশ মৎস্যসম্পদ (মাছ, আবরণযুক্ত জলজ প্রাণী ও শামুক) উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম, প্রাকৃতিক উৎসের মাছ উৎপাদনে তৃতীয় এবং ইলিশে শীর্ষ দেশ।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) হিসাবে ২০০৮ থেকে ২০১৮ সময়ের মধ্যে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়, সবার ওপরে ভিয়েতনাম। এক যুগের বেশি সময় ধরে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে।

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

সাফল্যের রহস্য 
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে মূলত তিনটি খাত। যেমন কৃষি, প্রবাসী আয় ও পোশাক খাত। এসব ক্ষেত্রে সরকারেরও নীতিগত অবদান আছে যথেষ্ট। যেমন কৃষিতে উচ্চফলনশীল জাত যেমন ফলন বাড়িয়েছে, তেমনি সরকারও কৃষি উপকরণ, সার ও বীজের বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। এখন এক জমিতে একাধিক ফসলের ফলন হয়। ফলে কৃষিজমি কমলেও বেড়েছে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ।

পোশাক খাতের দ্রুত সম্প্রসারণে আশির দশকে সরকারের দুটি সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্তকরী। যেমন ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র বা এলসি ও বন্ড সুবিধা। এর আওতায় কাপড়সহ আনুষঙ্গিক পণ্য উদ্যোক্তারা কোনো মূলধন ছাড়াই আমদানি করে তা বিনা শুল্কে রাখতেও পেরেছেন। এতে বড় ধরনের মূলধন ছাড়াই পোশাক খাতের উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব হয়েছে। আর ছিল অফুরান সস্তা শ্রমিক। তবে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে খোলা বাজারে কাপড় বিক্রি করে বিপুলভাবে লাভবান হওয়া উদ্যোক্তার সংখ্যাও কম ছিল না।

বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেক উৎস প্রবাসী আয়ের সম্প্রসারণ সেই আশির দশক থেকে। শুরু থেকে যথেষ্ট অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যেই অদক্ষ শ্রমিকদের বিদেশ যাত্রা ঘটেছে এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। দেশের যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, তাতে বড় অবদান রপ্তানি এবং প্রবাসী আয়।

ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ । প্রথম আলো ফাইল ছবি
ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ । প্রথম আলো ফাইল ছবি

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বাংলাদেশের উন্নয়ন বিস্ময় নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কোনো জবাবদিহিমূলক সরকারি ব্যবস্থা বা সমন্বিত উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেনি। বরং বিভিন্ন ধরনের উপাদান এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর সংযোগের ফল এটি। যেমন দাতাগোষ্ঠীর তহবিলনির্ভর পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি, স্বাধীনতা–পরবর্তী ত্রাণ কর্মসূচি পরিচালনাকারী সংস্থার উন্নয়ন এনজিও হিসেবে আবির্ভাব, গ্রামীণ রাস্তাঘাট নির্মাণে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিআরডি) বড় ভূমিকা, পোশাক খাতের রপ্তানি বাজার দখল এবং মধ্যপ্রাচ্যে অদক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিক রপ্তানি।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও মনে করেন, বাংলাদেশের এ পর্যন্ত অগ্রগতির পেছনে আরেকটি উপাদান হচ্ছে অল্প ব্যয়ের প্রযুক্তি গ্রহণ। অদক্ষ যেসব শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যে গেছেন, তঁাদের কাজের ধরন প্রযুক্তিনির্ভর ছিল না। কিংবা পোশাক খাতের শ্রমিকদের প্রযুক্তি জানার দরকার হয়নি। যে স্যালাইন ডায়রিয়াজনিত মৃত্যু কমাতে জাদুকরি ভূমিকা রেখেছে, সেটিও খুব সাধারণ পণ্য দিয়ে তৈরি। মানুষ খুব সহজে এসব স্বল্প প্রযুক্তি আয়ত্তে আনতে পেরেছে। এ ছাড়া ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতা ছিল পরবর্তী সব সরকারের জন্য একটি বড় শিক্ষা। সবাই বুঝেছিলেন যে আরেকটি দুর্ভিক্ষ আসতে দেওয়া ঠিক হবে না। এ কারণে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তাকে সব সরকারই গুরুত্ব দিয়ে আসছে।

সুশাসন কতটা জরুরি
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সুশাসনের বিপরীতমুখী সম্পর্কের আলোচনা বহু পুরোনো। একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা কয়েক দশক ধরেই বলে আসছে যে দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে জিডিপির ক্ষতি ২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলে, বাংলাদেশ যদি দুর্নীতির মাত্রা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর সমান পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে, তাহলে জিডিপি বাড়বে ২.১ থেকে ২.৯ শতাংশ পর্যন্ত। অথচ দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি কমেনি, কিন্তু জিডিপি ঠিকই বাড়ছে। এখানে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ দুর্নীতি পাশাপাশি চলছে।

‘প্যারাডক্স’ কথাটি বহুভাবেই ব্যবহৃত হয়। অর্থনীতির প্রচলিত তত্ত্ব অনুযায়ী যা কাজ করে না, মোটাদাগে তাকেই প্যারাডক্স বা আপাতবৈপরীত্য বলে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্যারাডক্স কথাটি ব্যবহৃত হচ্ছে গত এক দশকের বেশি সময় ধরেই।

এ বিষয়ে ২০১৩ সালে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির শিক্ষক অ্যান্টোনিও স্যাভোইয়া এবং মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক এম নিয়াজ আবদুল্লাহ ‘প্যাথস টু ডেভেলপমেন্ট: ইজ দেয়ার এ বাংলাদেশ সারপ্রাইজ?’ নামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে এক বাংলাদেশের দুই চিত্রের বিশ্লেষণ ছিল।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করা এম নিয়াজ আবদুল্লাহ এবং রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের এন এন তরুণ চক্রবর্তী বাংলাদেশের এই প্রসঙ্গ নিয়ে আরেকটি গবেষণা করেছেন। ‘গ্রোথ, গভর্ন্যান্স অ্যান্ড করাপশন ইন বাংলাদেশ: এ রি-অ্যাসেসমেন্ট’ শিরোনামের এই গবেষণা উন্নয়ন শিক্ষাবিষয়ক জার্নাল থার্ড ওয়ার্ল্ড কোয়ার্টারলির গত জুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে এই দুই গবেষক বলেছেন, অর্থনীতির টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য সুশাসন একটি প্রয়োজনীয় শর্ত—এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। দেশটির নাগরিকেরাও মনে করে চাকরি, বিচারব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও অন্যান্য সরকারি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি একটি বড় বাধা। এই ত্রুটিপূর্ণ সরকারি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেও এই বাংলাদেশই উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ কিন্তু একমাত্র উদাহরণ নয়। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান উচ্চ দুর্নীতির মধ্যে থেকেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। তবে এই তিন দেশে রাজনীতি–সংশ্লিষ্টরাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়েছেন বেশি। চীনে অবশ্য দুর্নীতি ও উন্নয়ন পাশাপাশি হাত ধরে চলেছে। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে চীনে অর্থনৈতিক অগ্রগতি যত ঘটেছে, দুর্নীতিও বেড়েছে তত বেশি। নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিক উন্নতি ও উচ্চ দুর্নীতির একসঙ্গে পথচলার চীনের সেই অভিজ্ঞতাকে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক অ্যান্ড্রু ওয়েডেমেন বলেছেন, ‘ডাবল প্যারাডক্স’।

উন্নয়ন বনাম দুর্নীতির আলোচনায় প্রচলিত একটি ধারণা হচ্ছে ‘স্যান্ড দ্য হুইলস’ তত্ত্ব। অর্থাৎ চাকা বালুতে যেমন আটকে যায়, দুর্নীতিও তেমনি উন্নতিকে আটকে রাখে। আবার এর বিপরীতেই অনেকে বলেন ‘গ্রিজ দ্য হুইল’-এর কথা। অর্থাৎ গ্রিজ বা তৈলাক্ত কোনো কিছু দিলে সেই চাকা ঘুরতে শুরু করে। এর অর্থ ঘুষ দিয়েই অনেক কাজ করানো যায়, এতে বাড়তি ব্যয় হলেও তা উন্নতিতে অবদান রাখছে। যেসব দেশে প্রতিষ্ঠান দুর্বল ও সুশাসন পরিস্থিতি ভালো নয়, সেসব দেশে এই নীতি শুরুতে কাজ দেয় বলে অনেক গবেষক মনে করেন। আরেকটি প্রচলিত মত হচ্ছে, উন্নয়নের শুরুতে দুর্নীতি দেখা দেয়, অগ্রগতি বাড়তে থাকলে দুর্নীতির চাহিদা ও আগ্রহ কমে যায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটিও দেখা যায়নি।

দুর্নীতির চালচিত্র
এম নিয়াজ আবদুল্লাহ ও এন এন তরুণ চক্রবর্তী বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। আশির দশকের পর থেকে পোশাক খাত ক্রমান্বয়ে এগিয়ে শীর্ষস্থানে চলে এসেছে। অথচ এই সময় দুর্নীতি পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিচালনা সূচকেও পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এ অবস্থার মধ্যে থেকেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত কীভাবে এগিয়ে গেল, সেটাই গবেষকেরা দেখতে চেয়েছেন।

এই দুই গবেষক পোশাক খাতের ৯২ জন মালিক ও ব্যবস্থাপকের বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে গবেষকেরা পাঁচটি ফলাফলের কথা জানিয়েছেন। যেমন ২২ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, ঘুষ সবচেয়ে বড় বাধা। ৩ দশমিক ৩ শতাংশ চাঁদাবাজিকে সবচেয়ে বড় সমস্যার কথা বলেছেন। দ্বিতীয়ত, ৪৯ শতাংশ বলেছেন ঘুষ ও চাঁদাবাজি কোম্পানির প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করছে। তৃতীয়ত, ব্যবসায়ীরা কর বা শুল্ক পরিহার বা আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার-ইনভয়েস (দাম কম দেখানো) করার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেন। চতুর্থত, আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে কী পরিমাণ অর্থ ঘুষ দিতে হবে, তা কাস্টমস কর্মকর্তারাই ঠিক করে দেন। পঞ্চমত, বিদেশি কোম্পানিও সরকারের কাজ পেতে, যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে থাকে। মোদ্দা কথা হচ্ছে ঘুষ দেওয়াকে সবাই একটি রীতি বলে মেনে নিয়েছেন।

একটি কাজ পেতে কত দিন লেগেছে এবং কী পরিমাণ অর্থ ঘুষ দিতে হয়েছে, তারও একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে এই গবেষণায়। যেমন কোম্পানি গঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষ দিতে হয় ৩৪ হাজার ৩৩২ ডলার। আবার কোম্পানি গঠনের দলিল সংগ্রহ বা নানা ধরনের অনুমতি পেতে যে ঘুষ দিতে হয়, তাকে তঁারা অনানুষ্ঠানিক ব্যয় বলছেন। এর পরিমাণ ২৩ হাজার ৩৩০ ডলার।

অনুমোদন পাওয়ার পর কোম্পানির কার্যক্রম শুরুর জন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎ, গ্যাস, ও পানি সরবরাহ সংযোগ, টেলিফোন লাইনপ্রাপ্তি, ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন, ইত্যাদি। এসব কাজে দিতে হয় ১৪ হাজার ৮০৮ ডলার। এরপরে প্রতিটি রপ্তানির দলিলের জন্য ৫ দশমিক ৭১ ডলার ও প্রতিটি আমদানি কনসাইনমেন্টের জন্য ঘুষ দিতে হয় ১৪২ ডলার। গবেষকেরা বলছেন, মূলত এভাবে ঘুষ দিয়ে কাজ করাটাই এখানকার রীতি।

উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গী উচ্চ দুর্নীতি
২০০৫ সালে পোশাক রপ্তানিতে যখন কোটাব্যবস্থা উঠে যায়, তখন বাংলাদেশ ছিল টানা পঞ্চমবারের মতো শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। এরপর থেকে পোশাক খাতের চমকপ্রদ অগ্রগতি হলেও দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি অতি সামান্য। এমনকি সহজে ব্যবসা পরিচালনার সূচকেও বাংলাদেশ ক্রমে খারাপ পর্যায়ে গেছে। সুতরাং দুর্নীতি অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম বাধা—এই যুক্তি পোশাক খাতের ক্ষেত্রে খাটছে না। পোশাক খাতের অগ্রগতি বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের সামান্য উন্নতিও আনতে পারেনি।

বলা হয়ে থাকে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্নীতি কমায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ায়। আর টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নতি ঘটায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা–ও দেখা যায়নি। ২০১৪ সালের এ বিষয়ে এক গবেষণায় ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও সিমিন মাহমুদ বলেছিলেন, ১৯৯১ সালে একনায়কের শাসন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটেছিল। তবে এরপর চলতে থাকা রাজনীতির সংস্কৃতি দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশের বিস্তার ঘটায়নি, একটি জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ রাষ্ট্রেরও দেখা মেলেনি। শাসনব্যবস্থার মূলে রয়েছে অকার্যকর সংসদ, তীব্র দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার অনুপস্থিতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনীতিকীকরণ, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য আমলাতন্ত্র। এ ছাড়া প্রকটভাবে যা আছে তা হলো পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি, যেখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে আশ্রয়–প্রশ্রয় ও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

উচ্চ দুর্নীতির মধ্যেও বাংলাদেশে অগ্রগতি তাহলে কীভাবে ঘটছে, এ নিয়ে ২০১৪ সালে একটি গবেষণা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের
প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক ফয়সাল জে আহমেদ, এনা গ্রিনলিফ এবং বিশ্বব্যাংকের অড্রে স্যাকস। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে আসলে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য স্থিতিশীল ও আন্দাজ করা যায় এমন একটি দুর্নীতিব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। একে বলা যায় নিয়মানুগ ও ফলপ্রদ ঘুষ ব্যবস্থা।

শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিয়ে এম নিয়াজ আবদুল্লাহ এবং এন এন তরুণ চক্রবর্তীর উপসংহার হচ্ছে দুর্নীতির সঙ্গে প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক ইতিবাচক না নেতিবাচক? আসলে বাংলাদেশে ঘুষ-দুর্নীতি একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এখানে সরকারি অর্থের ব্যাপক অপচয় ও আত্মসাৎ হয়, এতে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ব্যয় আরও বেড়ে যায়। এ অবস্থায় সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ নেওয়ার সংস্কৃতিও বজায় থাকে।

আরেকটি তত্ত্বের কথা বলা যায়। যেমন সুশাসনের অভাব যেখানে, সেসব ক্ষেত্রে ‘ডিল’ বা লেনদেনভিত্তিক একটি অর্থনীতি চালু আছে। কোনো কোনো দেশের অর্থনীতি এর ওপর নির্ভর করেই পরিচালিত হয়। নিচের ছকটিতে এর ব্যাখ্যা মিলবে।

‘নেভিগেটিং দ্য ডিলস ওয়ার্ল্ড: দ্য পলিটিকস অব ইকোনমিক গ্রোথ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গবেষণা আছে দুই অর্থনীতিবিদ মির্জা এম হাসান এবং এবং সেলিম রায়হানের। সেখানে বলা আছে, ‘বাংলাদেশ আইনের শাসনের ভিত্তিতে চলে না। বাংলাদেশ চলে ডিলস বা নানা ধরনের লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে। যেমন তৈরি পোশাক ও ব্যাংক খাতে চলে খোলা বা ওপেন ডিল এবং বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতের ডিল বদ্ধ বা ক্লোজড। ১৯৭৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশ এই লেনদেনের ভিত্তিতেই চলে আসছে। আর এই লেনদেন বা ডিলে বেশ শৃঙ্খলা আছে। তার মানে হলো ঘুষ খেয়ে কাজটি করে দেওয়া হয়। আর এটাই হচ্ছে খারাপ শাসনব্যবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির আসল ব্যাখ্যা।’

আকবর আলী খান । প্রথম আলো ফাইল ছবি
আকবর আলী খান । প্রথম আলো ফাইল ছবি

আকবর আলি খান তাঁর পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে দুই ধরনের দুর্নীতির বর্ণনা দিয়েছিলেন। যেমন নির্ভরযোগ্য দুর্নীতি ও অনির্ভরযোগ্য দুর্নীতি। নির্ভরযোগ্য দুর্নীতি হলো সে ধরনের ব্যবস্থা, যেখানে ঘুষ দিলে লক্ষ্য অর্জন নিশ্চিত। বিনিয়োগকারীদের এ ধরনের দুর্নীতিতে অরুচি নেই, বরং এ ধরনের দুর্নীতি তাঁরা পছন্দ করেন। অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো অনির্ভরযোগ্য দুর্নীতি। কেননা ঘুষ দিয়েও কার্যসিদ্ধির কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একনায়কতন্ত্র ও কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থাই নির্ভরযোগ্য দুর্নীতির জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।

অবশ্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কথা রাজনীতির মঞ্চে অহরহ শোনা যায়। ২০১৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা আছে। এ প্রসঙ্গে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডালের একটি কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। ১৯৬৮ সালে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে একটি বৈঠক প্রসঙ্গে সে সময় লিখেছিলেন, ‘ওপর মহলের সবাই যখন দুর্নীতি নিয়ে অহেতুক চিৎকার করতে থাকেন, তখন দুর্নীতি করার একধরনের পরিবেশ তৈরি হয়। মানুষ মনে করে, তারা দুর্নীতির আবহাওয়ার মধ্যে বসবাস করছে এবং তখন সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।’

সুতরাং ছোটবেলায় পড়া ‘সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা’ নীতি মেনে চলে কেউ যদি এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে চান, তাহলে তাঁর পক্ষে টিকে থাকা বাস্তবিকই অসম্ভব।

শেষ কথা
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সুশাসনের অধোগতির এ রকম এক ব্যবস্থার মধ্যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের এই ধারা কি বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকবে?

যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক অবিনাশ দীক্ষিত এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ল্যান্ট প্রিটচেট এ বিষয়ে বলেছিলেন, ‘যখন কোনো দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিম্ন পর্যায়ে থাকে, তখন সুশাসন ছাড়াও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়। তার কারণ, নিম্ন আয়ের দেশে প্রবৃদ্ধির অনেক সম্ভাবনা রয়েছে এবং এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু যখন একটি দেশ নিম্ন আয় থেকে মধ্যম আয়ের পর্যায়ে উপনীত হয়, তখন সুশাসনের প্রয়োজন অনেক বেড়ে যায়। সুশাসন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সম্পর্ক তখন সরলরৈখিক নয়। (অবাক বাংলাদেশ: বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি, আকবর আলি খান)।

বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। অন্যদিকে ২০২৪ সাল নাগাদ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর হওয়ার কথা। এতে অনেক ধরনের অগ্রাধিকার সুবিধা আর থাকবে না। বিশ্ব অর্থনীতিতেও থাকবে নানা উত্থান-পতন। এ রকম এক অবস্থায় উচ্চ দুর্নীতির সঙ্গী হয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি আর কত দিন চলবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

তাহলে কী করতে হবে? প্রশ্নটা ছিল ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কাছে। তিনি তিনটি করণীয়র কথা জানালেন। যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সেবার মান বাড়ানো। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ স্বল্প খরচের সমাধানের পর্যায় পার হয়ে এসেছে। এখন এই দুই খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ও সেবার মান বাড়ানো প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, সরকারের জবাবদিহি বাড়াতে হবে। এত দিন এই ঘাটতি নিয়েই বাংলাদেশ এগিয়েছে। কিন্তু এখন শাসনব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। সর্বশেষ হচ্ছে এত দিন এনজিওগুলোই মূলত সরকারি নানা সেবা সরবরাহ করে আসছে। কিন্তু এর সম্প্রসারণের জন্য, কমিউনিটিভিত্তিক সেবার জায়গা থেকে বের হতে একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

শেষ প্রশ্ন হচ্ছে সামনের দিনগুলোর জন্য বাংলাদেশের কি কোনো প্রস্তুতি আছে। নাকি রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করাই একমাত্র পথ। অর্থাৎ ‘এমনি ক’রেই যায় যদি দিন যাক না’।

শওকত হোসেন: প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক
[email protected]