পি কের ছায়া মুছতেই কি বদলে গেল নাম
তাঁর বড় পরিচয় ছিল, তিনি একজন অভিজ্ঞ ব্যাংকার। ছিলেন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। পরবর্তীকালে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকেরও এমডি হন। এই পদে থেকেই পি কে হালদার একের পর এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেন। এখন তিনি পলাতক। তবে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের প্রসঙ্গ উঠলেই এখনো তাঁর নাম চলে আসে। সে জন্যই হয়তো তাঁর অপকর্ম ও নামের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার কৌশল হিসেবে হঠাৎ প্রতিষ্ঠান দুটির নাম বদলে ফেলা হয়েছে।
দেশের আর্থিক খাতে বহুল আলোচিত এক নাম প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। এখন ‘পি কে’ নামেও সমধিক পরিচিত। এর পেছনে অবশ্য ভারতীয় চলচ্চিত্র তারকা আমির খানের পিকে সিনেমারও একটা প্রভাব থাকতে পারে। কারণ, ভণ্ড সাধু-সন্ন্যাসীদের অপকর্ম তুলে ধরায় সিনেমাটি নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছিল। সে জন্যই হয়তো বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে পি কের (পি কে হালদার) অনিয়ম, দুর্নীতি, কেলেঙ্কারিও তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়। পি কের নানা অপকর্ম নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে।
হল–মার্ক, বিসমিল্লাহ, ক্রিসেন্ট, অ্যাননটেক্স, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা) এসব প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত আর্থিক কেলেঙ্কারির চেয়ে পি কে হালদারের অপকর্ম কোনো অংশেই কম নয়, বরং বেশিই বলা যায়। কারণ, পি কে হালদারের নাম জড়িয়ে আছে কমপক্ষে পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও একটি ব্যাংকের সঙ্গে।
এ ছাড়া শেয়ারবাজার, কুমিরের খামার এবং পাঁচ তারকা হোটেলের মালিকানা রয়েছে পি কের নামে। এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বের করে নিয়ে আরেকটি কেনা ছিল তাঁর বড় নেশা। এভাবে একটি নয়, একে একে চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেছেন তিনি। একটিতে এমডি পদে থেকে বড় ধরনের টাকাও সরিয়েছেন। সব মিলিয়ে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার অনিয়ম–দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম।
তবে পি কে হালদারের বড় পরিচয় ছিল, তিনি একজন অভিজ্ঞ ব্যাংকার। তিনি ছিলেন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। পরবর্তীকালে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকেরও এমডি হন। এই পদে থেকেই পি কে হালদার একের পর এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেন। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বের করে তিনি অন্য প্রতিষ্ঠানের মালিকানা কেনেন। এতে দেশের গোটা আর্থিক খাত সংকটে পড়ে।
এদিকে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নাম পাল্টানো হয়েছে। এটা করা হয়েছে গত ছয় মাসে। ফলে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এখন আভিভা ফাইন্যান্স লিমিটেড। এর চেয়ারম্যান পদে রয়ে গেছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম। তাঁর পরিবারের সদস্য ও কর্মকর্তারা আছেন পরিচালক হিসেবে।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক হয়ে গেছে। এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান প্রবাসী নিজাম চৌধুরী হলেও এটির সিংহভাগ মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ এখন এস আলম গ্রুপের হাতে। ব্যাংকটিতে পরিচালক হিসেবে আছেন এস আলম গ্রুপের দুই ভাই শহীদুল আলম, ওসমান গনিসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং কর্মকর্তারা।
আলাপকালে আর্থিক খাতের অনেকেই জানান, তাঁরা রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নাম পরিবর্তনের বিষয়টিকে একটি কৌশল বা চাতুরী হিসেবেই দেখছেন। তাঁরা বলেন, পি কে হালদারের নাম এলেই রিলায়েন্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নাম চলে আসে। আবার এই দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম উঠলেও পিকে হালদারের নাম চলে আসে। এ কারণেই হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠান দুটির নাম পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। পাশাপাশি নামের ইসলামীকরণও লক্ষ করা গেছে। এদিকে এস আলম গ্রুপও কোনোভাবেই পি কে হালদারের দায় নিতে চাইছে না।
তবে এসব বক্তব্য মানতে রাজি নন গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিজাম চৌধুরী। তিনি আমেরিকা থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইসলামি হওয়ার কারণে নাম বদলে গেছে। সবাই চেয়েছে, এ জন্য নাম পরিবর্তন হয়েছে।’
একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন হওয়ার মানে নতুন করে যাত্রা শুরু করা। এতে বাড়তি অর্থ খরচ করতে হয়। যেমন যত জায়গায় ব্যাংকের নাম আছে, সবই পরিবর্তন করতে হবে। সেটা করতে হবে প্রধান কার্যালয় থেকে শুরু করে শাখা, এটিএম এবং সব ধরনের নথিপত্রে। ফলে হঠাৎ করে নাম পরিবর্তন করাটা বেশ কঠিন। আবার ইসলামি হয়ে গেলে নাম পরিবর্তন করতে হবে, এমন কোনো নীতি আর্থিক খাতে নেই। যেমন স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ইতিমধ্যে ইসলামি হয়ে গেলেও এখনো আগের নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
ফলে নাম পরিবর্তন করেই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া, অর্থাৎ দুর্নাম থেকে প্রতিষ্ঠান দুটি রক্ষা পাবে কি না, তা সময়েই বলে দেবে। পি কে হালদারের অনিয়ম-দুর্নীতির যেসব খবর বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে মিলছে, সেসবের পেছনেও কেউ ছিল কি না, তা জানতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো।
[email protected]