তোমরা যারা টাকা পাচার করো
টাকা পাচারকারীদের জন্য সুখবর। আপনারা মহা আনন্দে টাকা পাচার করে যান। আজকাল তো আপনারা সুইস ব্যাংকে টাকা কম রাখছেন। কেননা, টাকা পাচার ও তা লুকিয়ে রাখার জন্য এখন বহু জায়গা আছে। সুতরাং নির্ভয়ে পাচার করুন। কারণ, আপনাদের নাম অর্থমন্ত্রী জানেন না।
যেহেতু অর্থমন্ত্রী জানেন না, সেহেতু সরকারের অন্য কেউ জানেন না বলেই ধরে নিতে পারি। যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানেন না, ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট (বিআইএফইউ) জানে না, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান জানেন না, এমনকি দুর্নীতি দমন ব্যুরোর (দুদক) চেয়ারম্যানও জানেন না। তাঁরা জানলে তো অর্থমন্ত্রীরও জানার কথা।
তাহলে অর্থ পাচারের তথ্য কে জানে? নিশ্চয়ই অর্থ পাচারকারীরা অর্থমন্ত্রীর কানে কানে তাঁদের নাম বলে যাবেন না। তবে নিয়ম হচ্ছে কানে কানে না বলে গেলেও যদি চোখ-কান খোলা থাকে, তাহলে পাচারকারীদের নাম জানা সম্ভব। অর্থমন্ত্রীর এই চোখ বা কান হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিআইএফইউ, এনবিআর বা দুদক। সমস্যা হচ্ছে সবাই যদি আশা করেন যে পাচারকারী অর্থ পাচার করেই তাঁদের কানে কানে বলে যাবেন, তাহলেই মুশকিল।
অর্থমন্ত্রী গতকাল জাতীয় সংসদে পাল্টা টাকা পাচারকারীর তথ্য বিরোধী দলের সদস্যদের কাছে চেয়েছেন। ভাগ্যিস নিজের দলের সদস্যদের কাছে তা চাননি। যেমন, নাটোরের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম ওরফে শিমুল। প্রথম আলোসহ একাধিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে কানাডার স্কারবোরো শহরে তাঁর স্ত্রী শামীমা সুলতানা ওরফে জান্নাতীর নামে ১৪ লাখ ৫৬ হাজার কানাডীয় ডলার বা প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকায় একটি বাড়ি কেনা হয়েছে। শামীমা সুলতানার নিজস্ব আয়ের কোনো উৎস নেই। তাহলে এই অর্থ বাংলাদেশ থেকে গেল কীভাবে? সংসদে অর্থমন্ত্রী অর্থ পাচারকারীদের নাম চাওয়ায় এখন বিরোধী দলের সদস্যরা শফিকুল ইসলাম বা তাঁর স্ত্রীর নামটি দেবেন কি না, সেটা একটা প্রশ্ন।
তবে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে, লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহিদ ইসলামের নামটি দিয়ে দেওয়া। অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগে তিনি এখন কুয়েতে জেল খাটছেন। গর্তে পড়া হাতির মতো তাঁর নামটি দিয়ে দিলে কেউ আর কিছু বলবে না। অতীতে মোহাম্মদ শহিদ ইসলামের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে যাঁরা তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রীকে সাংসদ বানিয়েছিলেন, তাঁদের তো এত দিনে সেই অর্থ হজম হয়ে যাওয়ার কথা।
একটু আশার আলো অবশ্য ছিল। হাইকোর্ট অর্থ পাচার নিয়ে করা একটি রিটের শুনানি করছেন। সর্বশেষ শুনানি হয়ে গেল গত ২৪ অক্টোবর। তবে ওই দিন আদালতের বক্তব্যে অবশ্য আশাহতই হতে হচ্ছে। যেমন, শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে আদালত বলেছিলেন, ‘গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রুল দেওয়া হয়। এত দিন হয়ে যাচ্ছে। রুলের আদেশটাই যদি বাস্তবায়ন না করেন, তাহলে আর কী বলব? কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। এটা কোনো কথা হলো না। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে?’
সম্ভবত হাইকোর্টের কথাটাই ঠিক। কেননা, ঘুমিয়ে থাকলে কি আর চোখ-কান খোলা থাকে? থাকে না বলেই কেউ জানেন না টাকা পাচারকারী আসলে কারা। কেবল যে কেউ জানেন না, তা–ই নয়, জানার আগ্রহও নেই। ফলে টাকা পাচারের তথ্য জানার জন্য আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার সঙ্গেই কোনো কার্যকর চুক্তি নেই বাংলাদেশের। অথচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিকই জানেন কানাডার বেগম পাড়ায় কারা কারা বাড়ি কিনেছেন।
সরকারদলীয় বেশ কয়েকজন সাংসদ আছেন, যাঁদের কানাডা সফরের সংবাদ একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে। চোখ–কান খোলা থাকলে অর্থমন্ত্রী সিঙ্গাপুরের গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর কথা জানতেন, যিনি সেখানে একাধিক পাঁচ তারকা হোটেল কিনে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। ব্যাংককে প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ীর বিশাল বাড়ি ও রেস্তোরাঁ ব্যবসার কথা জানেন না ব্যাংক পাড়ায় এমন কম মানুষই আছেন। তাঁদের নতুন নতুন বিনিয়োগের কথা একাধিক দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। টাকা পাচারকারী এ রকম অনেকেই আছেন, যাঁদের তথ্য ‘ওপেন সিক্রেট’। অর্থাৎ সবাই জানেন, কিন্তু প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চান না। এঁরা এতটাই প্রভাবশালী যে চোখ–কান খোলা রাখার সাহস না করাই হয়তো ভালো মনে করছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। ফলে সংসদে কেবল আলোচনা হয়, নাম জানা নিয়ে বিতর্ক হয়, কিন্তু নাম জানার চেষ্টার কথা কেউ বলেন না।
সুতরাং যাঁরা টাকা পাচার করেন, আনন্দেই থাকেন। আপনাদের নাম জানার চেষ্টা কেউ করছে না।