তিন কারণে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা
গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের এক জরিপে উঠে এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ বেকার। এ জরিপের ফল নিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর শনিবার প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে শিক্ষিত বেকার বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন চাকরির তথ্য প্রদানকারী অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বিডিজবস ডটকমের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাসরুর। অনুলিখন করেন সুজয় মহাজন।
গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন স্নাতক পাস ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার থাকছেন। সরকারি এ গবেষণা সংস্থার জরিপের তথ্যকে যথাযথই মনে করেন চাকরির তথ্য প্রদানকারী অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বিডিজবস ডটকমের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাসরুর। তিনি বলেন, ‘বিআইডিএসের জরিপে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তার সঙ্গে আমি শতভাগ একমত। অনেক দিন ধরে আমরা এসব বিষয়ে কথা বলছিলাম। এখন জরিপে তার সত্যতা পাওয়া গেল।’
ফাহিম মাসরুর বলেন, ‘মূলত তিনটি কারণে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রথমত, চাকরির বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে। চাকরির বাজারে যে চাহিদা রয়েছে, সে রকম লোক আমরা তৈরি করতে পারছি না। আবার প্রতিবছর যেসব শিক্ষিত লোক চাকরির বাজারে যুক্ত হচ্ছেন, তাঁদের উপযোগী চাকরি নেই। গত ১০ বছরে দেশে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কারণ, দেশে প্রতিনিয়ত সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। ১০ বছর আগেও বছরে ২ থেকে আড়াই লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরির বাজারে যুক্ত হতেন। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে চার-পাঁচ লাখে উন্নীত হয়েছে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীরা শহর ও শোভন কাজ করতে চান। কিন্তু শহরে যত চাকরিপ্রার্থী প্রতিবছর তৈরি হচ্ছে, সেই পরিমাণ চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না।’
দ্বিতীয়ত, দেশে বর্তমানে চাকরির সুযোগ বাড়ছে উৎপাদনশীল ও কৃষি খাতে। দুটি খাতে আবার স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস তরুণদের কাজের সুযোগ কম। এ দুই খাতে কারিগরিভাবে দক্ষ লোকের চাহিদা বেশি। কিন্তু যেসব শিক্ষিত যুবক চাকরির বাজারে রয়েছেন, তাঁরা এসব কাজে নিজেদের যুক্ত করতে চান না।
এ ছাড়া করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে যেসব শিক্ষিত যুবকেরা নিজেরা ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে স্বকর্মসংস্থানে যুক্ত ছিলেন, তাঁরাও বেকার হয়ে পড়েছেন। এসব ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের হাতে সরকারের প্রণোদনার অর্থও খুব একটা পৌঁছায়নি। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। এতেও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। দেশে শিক্ষিত বেকার বেড়ে যাওয়ার এটি তৃতীয় কারণ।
ফাহিম মাসরুর মনে করেন, গত পাঁচ-সাত বছরে তরুণ চাকরিপ্রার্থীদের চিন্তা ও পছন্দের জায়গাতেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। একসময় শিক্ষিত তরুণেরা ভালো বেতনের আশায় বেসরকারি চাকরির প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন, এখন হয়েছে ঠিক উল্টো। সরকারি চাকরিতে যেভাবে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, বেসরকারি খাত সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এখন মেধাবী ও শিক্ষিত তরুণেরা বেসরকারি চাকরির বদলে সরকারি চাকরিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এ জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতিও নেন তাঁরা। আর এ সময়টাতে তাঁরা স্বেচ্ছায় বেকার থাকার পথকে বেছে নেন। এতেও শিক্ষিত বেকারত্বের হার বেড়ে যাচ্ছে।
ফাহিম মাসরুরের মতে, ‘এখন সময় এসেছে বাজারভিত্তিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করার। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরির নামে বেকারত্ব না বাড়িয়ে চাহিদানির্ভর শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা। বাজারে চাহিদা কারিগরি শিক্ষার। আর আমরা নতুন নতুন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে সেখানে বিবিএ, এমবিএ শিক্ষা চালু করছি। কিন্তু এত বিবিএ-এমবিএর আদৌ দরকার আছে কি?’
ফাহিম মাসরুর মনে করেন, বেকারত্ব মোকাবিলায় গতানুগতিক চেষ্টায় বেশি কাজ হবে না। এ সমস্যার একটি সমাধান হতে পারে কারিগরি শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা। বিবিএ পড়া বা ইংরেজিতে বা ইতিহাসে অনার্স পড়া একজন শিক্ষার্থীকে যেকোনো একটি কারিগরি বিষয়ে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আরেকটি সমাধান হতে পারে ইন্ডাস্ট্রিকে প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত করা। সরকার প্রতিটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট দিতে পারে, সবাই নির্দিষ্টসংখ্যক ‘ফ্রেশ’ গ্র্যাজুয়েটকে প্রতিবছর তিন থেকে ছয় মাসের জন্য ইন্টার্ন হিসেবে নিয়োগ দেবে। তাদের বেতন সরকার সরাসরি মোবাইল হিসাবে দিয়ে দেবে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো তরুণদের সুযোগ দিতে উৎসাহিত হবে। কারণ, এতে তাদের কোনো খরচ হবে না। তাদের মূল দায়িত্ব হবে ‘অন দ্য জব’ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। প্রশিক্ষিতদের অনেকেরই প্রশিক্ষণ শেষে সেই প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত চাকরি হতে পারে। এতে একদিকে যেমন প্রশিক্ষণের সমস্যার সমাধান হবে, অন্যদিকে অনেক নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে।