টাকার খোঁজে সরকার

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

খরচ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। ব্যয়ের খাত কেবল বড়ই হচ্ছে, অথচ আয়ে আছে বড় ঘাটতি। ব্যয়ের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ নেই সরকারের কাছে। বরং টাকার সংকটে আছে সরকার। 

সরকার পরিচালনার খরচ বেড়েছে। বাড়ানো হয়েছে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়ায় সুদ পরিশোধ ব্যয়সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আকার বাড়ছে উন্নয়ন ব্যয়ের। আরও আছে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের বিপুল আগ্রহ। 

সব মিলিয়ে সরকারের ব্যয়ের তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু রাজস্ব আয়ের বাইরে সরকারের জন্য অর্থের উৎস হচ্ছে ঋণ নেওয়া। আর এই ঋণ এখন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে সরকার অর্থ সংস্থানের নানা উপায় খুঁজছে। যেমন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার অলস অর্থ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন, মহাসড়ক থেকে টোল আদায়, টেলিকম কোম্পানির কাছ থেকে চাপ দিয়ে অর্থ আদায় ইত্যাদি। সরকার এখন যেকোনোভাবে অর্থ পেতে যে মরিয়া, এটি তারই প্রমাণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আবার সরকারের ব্যয় বাড়লেও এর স্বচ্ছতা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি, একতরফাভাবে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি, জবাবদিহির অভাব, জনগণের করের টাকায় সরকারি বিভিন্ন অদক্ষ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, করের বোঝা বৃদ্ধি—এসব নিয়েও আছে নানা সমালোচনা। 

বড় ব্যয়, কম আয়
২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আয়ে মোট ঘাটতি ছিল ৭২ হাজার কোটি টাকা। তবে পরবর্তী সময়ে বাজেট সংশোধন করলেও রাজস্ব আয়ে মোট ঘাটতি দাঁড়ায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আয়ে বড় ঘাটতি নিয়েই শুরু হয়েছে নতুন ২০১৯-২০ অর্থবছর। 

কর-জিডিপির অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সর্বনিম্ন অবস্থানে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় নিজেই বলেছেন, ‘দেশে ৪ কোটি নাগরিক মধ্যম আয়ের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও আয়কর দেয় মাত্র ২১-২২ লাখ।’ আয় বাড়াতে গত ১ জুলাই নতুন ভ্যাট আইন চালু করা হলেও ব্যবসায়ীদের চাপে তা অনেকটা প্রায় আগের আইনের মতোই রয়ে গেছে। এ থেকে রাজস্ব আদায়ে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন না। আবার উৎসে কেটে নেওয়া হয় বলে চাকরিজীবীদের কাছ থেকেই আয়কর বেশি পায় সরকার। যাঁরা ফাঁকি দেন, তাঁরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন। সব মিলিয়ে সরকারের আয় বাড়ানোর পথ এখনো অনেকটাই সীমিত হয়ে আছে। 

তারপরও চলতি অর্থবছরের জন্য সরকারের ব্যয় পরিকল্পনা বিশাল, প্রায় সোয়া ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা, বাকিটা সরকারের পরিচালন ব্যয়। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্য প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। 

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের বিপুল অর্থ খরচের চাহিদা আছে। কিন্তু সরকার এখন আয় করার কঠিন পথে না গিয়ে সহজ পথে হাঁটার চেষ্টা করছে। রাজস্ব আদায়ের পরিধি বাড়ানোর দিকেই সরকারের এখন নজর দেওয়া উচিত। তা না করে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে টাকা নিতে চায়। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই। কিন্তু এত কম রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত দিয়ে তা সম্ভব নয়। তাই অর্থ সংগ্রহের সহজ পথে না গিয়ে রাজস্ব খাত সংস্কারের কঠিন পথেই যেতে হবে।’ 

ঋণের ফাঁদে সরকার
এদিকে, আয়ের তুলনায় ব্যয় যত বাড়ছে, সরকারও তত বেশি ঋণের ফাঁদে পড়ছে। যেমন গত অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের অর্থায়নের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ৯০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরেও তা ছিল সাড়ে ৮৭ হাজার কোটি টাকা। সরকারের নেওয়া মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ এখন জিডিপির প্রায় ১৭ শতাংশ।

গত ১০ বছরে সরকার সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। এতে দুর্নীতি না কমলেও ব্যয় বেড়েছে বিপুল। মোট বাজেটের ২৮ শতাংশই খরচ হয় বেতন, ভাতা ও পেনশন খাতে। আরেকটি বড় খাত হচ্ছে সুদ পরিশোধ, প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ। সরকার প্রতিবছর ঋণ করে ঘাটতি মেটাচ্ছে। আর এ ঋণের বড় অংশই আসছে ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্রের মতো অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। সঞ্চয়ের নিরাপদ বিকল্পের অভাব ও জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও কমাতে পারছে না। এতে সুদ পরিশোধ ব্যয়সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশাল বাজেট-বড় ঘাটতি-ব্যয়বহুল ঋণ-সুদ পরিশোধ-আবার বড় বাজেট-আবার ঘাটতি-আরও সুদ পরিশোধ—এভাবেই ঋণের এই ফাঁদে পড়ে আছে বাংলাদেশ। 

অর্থের সন্ধানে সরকার
স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ—এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে এখন প্রায় সোয়া ২ লাখ কোটি টাকা আছে। সরকারের নজর এখন এখানে। এই অর্থের ৭৫ শতাংশ নিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করতে একটি নতুন আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিপরিষদ। 

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিডিপি) সদস্য শামসুল আলম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সিদ্ধান্তটি অর্থনীতির জন্য খুব ইতিবাচক। এসব প্রতিষ্ঠান তো সরকারেরই। এই উদ্যোগ কার্যকর হলে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা পাওয়া যাবে, যা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) সমান। সরকার এখন বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, টাকার দরকার আছে। 

>সব মিলিয়ে সরকারের ব্যয়ের তালিকা দীর্ঘ
আয়ে বড় ঘাটতি নিয়েই শুরু নতুন অর্থবছর
ব্যয় যত বাড়ছে, সরকার তত ঋণের ফাঁদে পড়ছে
সরকারের ব্যয় বাড়লেও স্বচ্ছতা নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন
ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকার আয়ের নতুন পথ খুঁজছে


তবে সরকারের এই পরিকল্পনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এতে তারল্যসংকটে থাকা ব্যাংকিং খাতে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নিলে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। সরকার কীভাবে বিষয়টি ব্যবস্থাপনা করবে, এটা বড় বিষয়। কারণ, বেসরকারি, বিশেষত নতুন ব্যাংকগুলো এসব টাকার ওপর নির্ভর করেই চলছে। 

এদিকে, টেলিযোগাযোগ খাতের বড় দুই কোম্পানি গ্রামীণফোন ও রবির কাছে ১৩ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা পাওনা আদায়ে নানাভাবে চাপ দিচ্ছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। বরং চাপ দিয়ে অর্থ আদায় করা সম্ভব বলে সরকারের একটি পক্ষের ধারণা। 

পাশাপাশি ৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে দেশের জাতীয় মহাসড়ক ব্যবহারের ওপর টোল আদায়ের নির্দেশ দেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বুধবার এ নিয়ে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘দেশের মহাসড়কে টোল আদায়ে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের পর এখান থেকে সরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রী নিজেই যেহেতু ঘোষণা দিয়েছেন এরপর তো নড়ন-চড়নের কোনো বিষয় নেই।’ চারটি মহাসড়কে টোল আরোপের বিষয়ে প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি। 

মহাসড়কে টোল আদায় করা হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান এ বিষয়ে বলেন, অনেক দেশেই সাধারণ সড়কের বিকল্প হিসেবে টোল রোড থাকে। সেখানে নিরবচ্ছিন্ন গতি ও রাস্তা ভালো থাকে বলে বাড়তি খরচ দিলেও চাপ তৈরি হয় না। বাংলাদেশে রাস্তাঘাট যদি একই থাকে, চলাচল নিরবচ্ছিন্ন না হয়, তাহলে টোলের কারণে মানুষের ব্যয় বাড়বে। 

খরচ বেশি, জবাবদিহি কম
সরকার এখন ১১টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই ১১ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা আছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। বেশির ভাগ বড় প্রকল্পেই খরচ ও বাস্তবায়নের সময় বেড়েছে। এতে এর অর্থনৈতিক উপযোগিতাও কমছে। আবার সরকার এখন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি সহায়তার তুলনায় স্থানীয় উৎস থেকে বেশি অর্থ ব্যয় করছে। এই অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। ফলে প্রকল্পে একেকটি বালিশের দাম পড়ছে ৬ হাজার টাকা, চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি বই কেনা হচ্ছে ৮৫ হাজার টাকায়, আর পর্দার দাম হয়ে যাচ্ছে ৩৭ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এখন তহবিল ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের ঘাটতি একদিকে দুর্নীতি বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝাও চাপছে। 

সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করছে। ১ টাকার কাজ ৫ টাকায় হচ্ছে। জনগণের সম্পদের স্বচ্ছ ব্যবহার করা গেলে এমনটি হতো না। এটা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার একটা বড় দুর্বলতা। 

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, দেশীয় উৎস থেকে ঋণ করলে খরচের জবাবদিহি কম। বিদেশি ঋণে অনেক শর্ত থাকে। এ জন্য সরকার দেশীয় উৎসের দিকেই ঝুঁকছে। এতে দেশের ব্যবসায়ীদের ঋণ নেওয়ার সুযোগ যেমন কমে আসছে, তেমনি করের বোঝা কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণের ওপর পড়ছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়।