কোনো এক অর্থমন্ত্রীর অর্থ পাচারকারীর নাম উদ্ধারের কাহিনি
জনপ্রিয় ব্রিটিশ লেখক জেফরি আর্চার পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। কনজারভেটিভ পার্টির ডেপুটি চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। যদিও নানা ধরনের স্ক্যান্ডালের কারণে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটেছে অনেক আগেই। তবে লেখক হিসেবে তিনি এখনো যথেষ্ট জনপ্রিয়। তাঁর একাধিক বই বেস্টসেলারের তালিকায় আছে।
জেফরি আর্চারের গল্পটির নাম ‘ক্লিন সুইপ ইগনেশিয়াস’। এর বাংলা করলে দাঁড়ায়, ঝাড়ুদার ইগনেশিয়াস। এই গল্পটার উল্লেখ কেন, তা একটু বলা প্রয়োজন। জাতীয় সংসদে গতকাল সোমবার অর্থ পাচার নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে। কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রীও।
এমন নয় যে অর্থ পাচার নিয়ে এটাই সংসদে প্রথম আলোচনা। বলা যায় যুগ যুগ ধরেই হচ্ছে। বিশেষ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) যখন বৈশ্বিক অর্থ পাচারের প্রতিবেদন প্রকাশ করে তখন একবার। আরেকবার আলোচনা হয় সুইস ব্যাংকে কোন দেশের কত অর্থ আছে, সেই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর। তখন সরকারের পক্ষ থেকেও নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এবার অবশ্য অর্থমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দেননি, উল্টো নিজেই অন্যদের কাছ থেকে অর্থ পাচারকারীর নাম বা তথ্য চেয়েছেন। অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতি বলা যায় এটুকুই।
এবার তাহলে জেফরি আর্চারের গল্পটা বলা যাক। উপসংহারে পৌঁছানোর দায়িত্ব পাঠকদের।
নাইজেরিয়ার ১৭তম অর্থমন্ত্রী হিসেবে যখন ইগনেশিয়াস আগারবি দায়িত্ব নিলেন, তখন কেউই খুব একটা উচ্ছ্বাস দেখায়নি। কারণ, অর্থমন্ত্রীদের আসা-যাওয়ায় সবাই তত দিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এমনকি তিনি যখন দায়িত্ব নিয়েই সংসদে দেশ থেকে দুর্নীতি আর অরাজকতা ঝেঁটিয়ে দূর করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেন, তখনো কেউ উচ্চবাচ্য করলেন না। এমনকি নাইজেরিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা দ্য ল্যাগোস ডেইলি তাঁর সেই বক্তব্য ছাপালই না।
ইগনেশিয়াস কিন্তু ঠিকই নিজেকে সবার নজরে আনলেন। প্রথমেই দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার করা হলো এক ছোট সরকারি কর্মকর্তাকে। সেই কর্মকর্তা শস্য কেনাবেচার কাগজ জাল করেছিলেন। ইগনেশিয়াসের ঝাড়ুর দ্বিতীয় আঘাতে আমদানি-রপ্তানিতে অনিয়মের দায়ে দেশ থেকে বহিষ্কৃত হলেন এক লেবানিজ ব্যবসায়ী। তৃতীয় ঘটনাটি অনেক বেশি চমকপ্রদ ও অভাবনীয়। এবার ঘুষ নেওয়ার দায়ে গ্রেপ্তার হলেন দেশটির ইন্সপেক্টর জেনারেল। এমনকি তাঁকে ১৮ মাসের জেলও দেওয়া হলো। এ ঘটনা ইগনেশিয়াসকে অসম্ভব জনপ্রিয় করে তুলল। দ্য ডেইলি ল্যাগোসের প্রথম পাতায় দেখা গেল হাস্যোজ্জ্বল ইগনেশিয়াসকে। এবার তাঁকে আদর করে ‘ঝাড়ুদার ইগনেশিয়াস’ বলে ডাকা শুরু করল।
ইগনেশিয়াস এরপর ১০ কোটি ডলারের বেশি দরে করা চুক্তিগুলো খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া কোনো দামি চুক্তিই আর অনুমোদন পেত না। অর্থমন্ত্রী হিসেবে ইগনেশিয়াস দ্বিতীয় বছরে পা দিলে রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল ওটবি তাঁকে একদিন বৈঠকে ডাকলেন।
দুজনের মধ্যে কথোপকথনটা এ রকম—
‘ইগনেশিয়াস, আপনার করা শেষ বাজেট রিপোর্টটা আমি পড়ে শেষ করেছি। কিন্তু সরকারের রাজস্ব বিভাগ যেভাবে কোটি কোটি টাকা হারাচ্ছে, তা খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। আপনার রিপোর্ট অনুযায়ী টাকাটা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে বিদেশি সংস্থাগুলো মেরে দিচ্ছে। এরা কারা আপনার কোনো ধারণা আছে?
ইগনেশিয়াস বললেন, ‘আমার সন্দেহ হয়, অধিকাংশ অর্থই সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা হয়।’
এরপর জেনারেল বললেন, ‘বলুন, আপনার কী দরকার? যেকোনো ক্ষমতা আমি আপনাকে দেব। যেকোনো কিছু। আপনি ব্যবস্থা নিন। আর বোধ হয় আমার মন্ত্রিসভার সদস্যদের দিয়ে শুরু করাটাই ভালো হবে। পদমর্যাদা বা র্যাঙ্ক নিয়ে চিন্তা করবেন না, সেসব আমি সামলাব।’
‘আসলে এমন একটা দুরূহ কাজ সফলভাবে করতে গেলে আপনার নিজ হাতে সই করা একটা লেটার অব অথরিটি পেলে।’ ইগনেশিয়াস এ পর্যন্তই বললেন।
‘পাবেন। কাল সকাল আটটার মধ্যেই পেয়ে যাবেন।’ আশ্বাস দিলেন রাষ্ট্রপ্রধান।
ধন্যবাদ জানিয়ে ইগনেশিয়াস উঠে দাঁড়ালেন।
এরপর জেনারেল ইগনেশিয়াসকে অবাক করে দিয়ে একটা ছোট পিস্তল দিলেন। তারপর বললেন, ‘আশা করছি এর কোনো প্রয়োজন পড়বে না, তা–ও সাবধান থাকাই ভালো। এটাও নিয়ে যান।’
ইগনেশিয়াস অপ্রস্তুতভাবে জেনারেলের হাত থেকে অস্ত্রটা নিয়ে বিড়বিড় করে ধন্যবাদ জানালেন। এরপর দপ্তরে ফিরেই নতুন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। রাতের পর রাত খেটে একটা তালিকা বানালেন। এখন শিকার ধরতে প্রস্তুত। তারপর আগস্ট মাসের একদিন তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহরে উড়াল দিলেন। নির্দেশ দিলেন সফরের অর্থ যেন অবশ্যই তাঁর নিজস্ব হিসাব থেকে পরিশোধ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে স্ত্রী-পুত্রদের সেখানে রেখে সুইসএয়ারের একটা ফ্লাইট ধরলেন, যাবেন জেনেভা। সেখানে পৌঁছেই জেনে নিলেন গারবার অ্যাত সিয়ে নামের একটি সুইস ব্যাংকের নাম ও ঠিকানা। ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে জীর্ণ ও পুরোনো একটি ব্রিফকেস হাতে ইগনেশিয়াস হাজিরও হলেন সেখানে। ব্যাংকে তাঁকে নিতে এলেন চেয়ারম্যানের একজন ব্যক্তিগত সহকারী। ১১ তলার কক্ষে চেয়ারম্যান নিজেই স্বাগত জানালেন ইগনেশিয়াসকে। কফি খেতে খেতে দ্রুতই কাজের কথায় চলে এলেন তাঁরা।
‘আমার দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের বিশেষ অনুরোধ নিয়ে আজ আমি এসেছি। কাজটা হলো আমার দেশের কোন কোন নাগরিকের আপনার ব্যাংকে হিসাব আছে, তা খুঁজে বের করতে এসেছি।’
এটুকু শুনেই চেয়ারম্যান বললেন, ‘কিন্তু সেই তথ্য আপনাকে দেওয়ার অনুমতি... ’।
হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে ইগনেশিয়াস বললেন, ‘আমাকে আমার দেশের পক্ষ থেকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।’ এরপর পকেট থেকে একটা খাম বের করে চেয়ারম্যানের হাতে দিলেন।
চেয়ারম্যান জেনারেল ওটবির সই করা অনুমতিপত্রটি বের করে পড়লেন। তারপরও বলেন, ‘আমি দুঃখিত। আমার দেশে এই কাগজের কোনো মূল্যই নেই। তা ছাড়া ব্যাংকের গোপনীয়তা রক্ষার একটা আইন আছে। আইন অনুযায়ী এ ধরনের স্পর্শকাতর তথ্য মক্কেলদের অনুমতি ছাড়া কিছুতেই প্রকাশ করতে পারি না। এমনটাই ব্যাংকের নিয়ম।’
এবার ইগনেশিয়াস টোপ ফেললেন। বললেন, ‘আমাকে দেওয়া ক্ষমতা অনুযায়ী আমি আমার রাষ্ট্রের পক্ষে আপনার ব্যাংকের সঙ্গে এমন চুক্তি করতে পারি যাতে নাইজেরিয়া আর সুইজারল্যান্ডের ভবিষ্যৎ সমস্ত লেনদেন আপনার ব্যাংকের মাধ্যমেই হয়।’
তারপরও ব্যাংক চেয়ারম্যান আগের বক্তব্য অনড়। এবার একটু কঠোরভাবেই ইগনেশিয়াস সুইস ফরেন অফিসে ব্যাংকের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনার হুমকি দিলেন। তাতেও চেয়ারম্যান সায় না দিলে দ্বিতীয় হুমকিটি দিলেন। ইগনেশিয়াস বললেন, ‘এমন হলে নাইজেরিয়ার সঙ্গে যেকোনো সুইস নাগরিকের ব্যবসা স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হবে।’
‘এমনটা করা না করা আপনার ইচ্ছা, স্যার।’ বললেন অবিচল চেয়্যারম্যান।
‘সে ক্ষেত্রে আজকেই আমাদের জেনেভার দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি নাইজেরিয়ায় আপনাদের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করার ঘোষণা করা হবে। এ ছাড়া লন্ডনে ফিরে আমি একটা সংবাদ সম্মেলন করে আপনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনব।’
কিন্তু ব্যাংক চেয়ারম্যান আবারও একই কথা বললেন। এবার ইগনেশিয়াস চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তাহলে আপনি আমার জন্য আর কোনো পথই বাকি রাখলেন না।’
এবার ব্যাংক চেয়ারম্যান ভয়কম্পিত চোখে দেখলেন ইগনেশিয়াস পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে আনছেন। তারপর সেই অস্ত্র চেয়ারম্যানের কপালে চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘ওই নামগুলো আমার চাই। আপনি যদি নামগুলো না দেন, আমি আপনাকে খুন করতে বাধ্য হব। তারপর আমি নজর দেব আপনার সহকারীর দিকে।’ এই বলে ইগনেশিয়াস একবার চোখ রাখলেন পেছনে দাঁড়ানো সহকারীর দিকে। ভয়ে তখন ফোঁটা ফোঁটা ঘাম কপাল বেয়ে ঝড়ে পরছে ব্যাংক চেয়ারম্যানের। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। মক্কেলদের গোপন তথ্য কিছুতেই দেবেন না বলে পিস্তলের মুখেই জানিয়ে দিলেন।
‘আমি আপনাদের যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছি।’ এ কথা বলে ইগনেশিয়াস পিস্তলের হ্যামারটাকে পেছনে টেনে ধরলেন। ম্যানেজারের কপাল বেয়ে তখনো পানির মতো ঘাম ঝরছে। সহকারী যুবকটি সহ্য করতে না পেরে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল, এখন অপেক্ষা গুলির আওয়াজের।
‘চমৎকার।’ ইগনেশিয়াস চেয়ারম্যানের মাথা থেকে অস্ত্রটি সরিয়ে নিতে নিতে বললেন।
তারপর শান্তভাবে বসে পড়লেন আগের চেয়ারটাতে। এরপর সেই জীর্ণ ও পুরোনো ব্রিফকেসটাকে চেয়ারের পাশ থেকে তুলে কাচের টেবিলে রাখলেন। আংটা দুটি খুলতেই ডালা খুলে গেল। ব্যাংক চেয়ারম্যান ব্রিফকেসের ভেতরের সুন্দর করে সাজানো একশ ডলারের নোটগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেখেই মনে মনে হিসাব করে বুঝলেন, কম করে হলেও ৫ থেকে ৭ মিলিয়ন ডলার আছে ওখানে।
ইগনেশিয়াস এবার বললেন, ‘আচ্ছা বলুন তো, আপনার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার নিয়ম যেন কী?’