এ অর্থের মালিক কারা
সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের কত অর্থ আছে, সেই তথ্য সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই প্রকাশ করে। তারপরও সরকার ও দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ অর্থের মালিক কারা এবং কীভাবে তা দেশটিতে গেল, তা জানার কোনো উদ্যোগ নেই।
বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সরকার উদ্যোগ নিলে সহজেই এই অর্থের মালিকদের তথ্য জানা সম্ভব। কারণ, আন্তর্জাতিক আইনেই সেই সুযোগ তৈরি হয়েছে গত এক দশকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই অর্থ সম্পর্কে সরকার কখনোই জানতে চায় না। তাই সুইস ব্যাংকে থাকা অর্থের মালিকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। তাঁরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহ করে। কিন্তু বাংলাদেশ এ ধরনের উদ্যোগ নেয় না।
অথচ মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে বাংলাদেশের নিজস্ব একটি সংস্থাও রয়েছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) নামের এ সংস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে যে ভূমিকা লেখা আছে, সেখানে বলা হয়েছে, সন্দেহজনক যেকোনো ধরনের লেনদেন, মুদ্রা পাচার, সন্ত্রাসে অর্থায়ন–সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা এ সংস্থার প্রধান কাজ। আইন করেই এ সংস্থাকে বিদেশি অংশীদারদের কাছ থেকে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন–সংক্রান্ত তথ্য আদান–প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের এই অর্থ কাদের এবং কীভাবে জমা হয়েছে, তার কোনো তথ্যই নেই এ সংস্থার কাছে।
>বিশ্লেষকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় অর্থের তথ্য জানার সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সে উদ্যোগ নেওয়া হয় না
জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুইস ব্যাংকে যেসব অর্থ রয়েছে, তার পুরোটা এ দেশ থেকে পাচার হয়েছে, তেমন নয়। বিদেশে বসবাসকারী অনেক বাংলাদেশিও বৈধভাবে সেখানে অর্থ জমা রাখেন। আবার বাণিজ্যের আড়ালেও এ দেশ থেকে কিছু অর্থ পাচার হয়ে থাকতে পারে। আমরা চেষ্টা করছি ভারতের মতো করে দেশটি থেকে তথ্য সংগ্রহের। এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকও করেছি। কিন্তু করোনার কারণে সবকিছু থেমে গেছে।’
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) গত বৃহস্পতিবার ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০১৯’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখান থেকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমাসংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য পাওয়া গেছে।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সাল শেষে যার পরিমাণ ছিল প্রায় ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগের বছরের চেয়ে জমা অর্থের পরিমাণ ১৫১ কোটি টাকা কমেছে।
বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ সুইস ফ্রাঁর বিনিময়মূল্য ৮৯ টাকা ধরে এ হিসাব করা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে নানাভাবে অবৈধ উপায়ে পাচার হওয়া অর্থ যেমন সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা হয়, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকেরাও দেশটিতে অর্থ জমা রাখেন। তাই সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশিদের মোট অর্থের মধ্যে বৈধ–অবৈধ সব অর্থই রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এই বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোপনীয়তা আইনের কারণে একসময় পাচার করা অর্থ সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখতেন বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা। কিন্তু সুইজারল্যান্ড এখন সেই গোপনীয়তা আইন থেকে সরে এসেছে। তারপরও আমাদের সরকার রাজনৈতিক–অর্থনীতির কারণে অর্থ পাচারের তথ্য সংগ্রহে আগ্রহ দেখায় না। কারণ, অর্থ পাচারের ঘটনা যারা ঘটায়, তার সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকজন জড়িত থাকে। সরকারের সবুজসংকেত না থাকায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও এতে আগ্রহ দেখায় না।’
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ভারত তাদের নাগরিকদের জমা রাখা অর্থের তথ্য সংগ্রহ শুরু করায় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে ভারতীয়দের অর্থের পরিমাণ কমে আসছে। বাংলাদেশও যদি এ ধরনের উদ্যোগ নেয়, তাহলে দেশ থেকে অর্থ পাচারের প্রবণতা কমবে।
এসএনবির তথ্য অনুযায়ী, সুইস ব্যাংকে ২০১৯ সাল শেষেও ভারতীয়দের অর্থের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৬ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০ কোটি সুইস ফ্রাঁ। ২০০৭ সালের পর থেকেই সুইস ব্যাংকে ভারতের অর্থের পরিমাণ কমতে থাকে।
সুইস ব্যাংকে জমা থাকা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার পুরোটাই কি পাচার হওয়া অর্থ? দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ অর্থের সিংহভাগই অবৈধ উপায়ে পাচার হওয়া। সুইজারল্যান্ড জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে সই করা একটি দেশ। এ কারণেই তারা বিভিন্ন দেশের মানুষের অর্থ জমার তথ্য প্রকাশ করে। বছর বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের হিসাব প্রকাশ হলেও আমাদের সরকার কখনো এসব অর্থ কার, কীভাবে সেখানে গেল, তা জানতে চায়নি। এমনকি অর্থ পাচার ও দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এ কারণে সুইজারল্যান্ড ছাড়াও অফশোর দেশ বা দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতেও অর্থ পাচারের ঘটনা বেড়েছে।’