সংস্কার করতে হবে শ্রম খাতেও
কয়েক বছর ধরেই অর্থনীতি চাপে রয়েছে। ডলার-সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে ব্যাংক খাত। এমন এক পরিস্থিতিতে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরকার বদল হয়েছে। তাতে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় হামলার পাশাপাশি অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। আবার নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাস না পেরোতেই সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদীসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এ নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার।
দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে শ্রম অসন্তোষ চলছে। দাবিদাওয়া আদায়ে শ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় ও পদ্ধতিগত ভুল থাকতে পারে। তবে শ্রমিকদের দাবি অন্যায্য নয়।
ওষুধ খাতের অনেক কারখানার শ্রমিকের বেতন-ভাতা গত কয়েক বছর বাড়েনি। সুযোগ-সুবিধাও বাড়েনি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে ১২ ঘণ্টা কাজ করলেও তৈরি পোশাকশ্রমিকেরা টিফিন বিল পান মাত্র ২৫ টাকা। কারখানার উৎপাদন ঠিক রাখতে শ্রমিকেরা যাতে দেরিতে উপস্থিত না হন কিংবা অনুপস্থিত না থাকেন, সে জন্য ৫০০ টাকা প্রণোদনা দেন মালিকেরা। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা কয়েক শ টাকা বেশি চেয়েছিলেন। কারখানাগুলো শ্রম আইন ঠিকঠাক পরিপালন করলে শ্রমিকদের অধিকাংশ দাবি মানা হয়ে যায়। বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি সরকার-মালিক-শ্রমিকপক্ষ মিলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
শ্রম আইন পরিপালনের বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই)। বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল ডিআইএফই। তাহলে আইন লঙ্ঘন করলে মালিকদের বিরুদ্ধে কেন মামলা করতে পারেন না তাঁরা। আবার তাঁরা সরাসরি কোনো কারখানায় প্রবেশ করতে পারেন না। মালিকপক্ষ অনুমতি দিলেই কেবল কারখানায় ঢুকতে পারেন। ফলে অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করা গেলেই শ্রমিকদের অর্ধেক দাবিদাওয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হয়ে যায়।
পোশাকশ্রমিকেরা যখন দাবি উত্থাপন করেছিলেন, তখনই মালিকেরা তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। কিন্তু মালিকদের একটি অংশ তখন বিজিএমইএ দখল করা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অস্থিরতার সূত্রপাত। পরে শ্রমিকেরা মনে করেন, সবাই দাবিদাওয়া জানালে তাহলে তাঁরাও তো পারেন। তবে কাজ করেও শ্রমিকেরা দাবি আদায়ের আন্দোলন করতে পারতেন। অধিকাংশ কারখানামালিক ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেননি। ফলে সুশৃঙ্খলভাবে দাবি আদায়ের পরিবর্তে রাস্তায় নেমেছেন শ্রমিকেরা।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অনেক খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। শ্রম খাতেও সংস্কার করতে হবে। দেশের ৪২টি খাতে নিম্নতম মজুরি থাকলেও জাতীয় ন্যূনতম কোনো মজুরি নেই। আবার শ্রম আইন সংশোধন সব সময়ই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও পাশ্চাত্যের চাপে করা হয়। আইন সংশোধনে শ্রমিকদের কথা সেভাবে শোনা হয় না। বরং মালিকপক্ষ যেভাবে চায়, সেভাবেই করা হয়েছে। এখানেও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে হবে। মালিক ও শ্রমিকদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের দেশে শিল্প খাতে নারী শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে। তাঁদের সুরক্ষায় আইএলও কনভেনশন ১৯০ অনুসমর্থন করতে হবে। তারপর সে অনুযায়ী আইন করতে হবে। এ ছাড়া গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কনভেনশন ১৮৯ এবং শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ বিষয়ে কনভেনশন ১২১ অনুসমর্থন করা দরকার। দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। রানা প্লাজা ধস ও তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষতিপূরণের জন্য দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে হয়েছে শ্রমিকদের। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক নিহত হলে ক্ষতিপূরণ দুই লাখ টাকা। এই ক্ষতিপূরণ ৫০ লাখ টাকা হলে মালিকেরা ভয়ে থাকতেন। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সব করতেন। ফলে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। শ্রমিকদের জীবনের মূল্য দিতে হবে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে এসব কাজ করতে হবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন চর্চায় প্রতিবন্ধকতাগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। যাতে কারখানায় মালিক ও শ্রমিকের আলোচনার জন্য শক্ত টেবিল থাকে।
লেখক–কল্পনা আক্তার, সভাপতি, বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন