উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ছোট হয় পণ্যের আকার, কেন এই ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’ নীতি

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সবজির আড়তের ভেতরে শিঙাড়া বিক্রি করেন খায়রুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। করোনার সময় থেকে শুরু হয়েছে তাঁর এই শিঙাড়া বিক্রি। ২০২০ সালে পাঁচ টাকায় শিঙাড়া বিক্রি শুরু করেন তিনি; এখনো পাঁচ টাকায় বিক্রি করছেন। পার্থক্য হলো, এখন পাঁচ টাকার শিঙাড়াকে তখনকার দুই টাকার শিঙাড়া বলে ভুল হতে পারে।

ফলে এই শিঙারা খেয়ে যাঁরা উদরপূর্তি করতে আসেন, তাঁদের হয় কম খেয়ে তৃপ্ত থাকতে হয়, না হয় বেশি টাকা খরচ করতে হয়।

একই পরিস্থিতি দেখা যায় রাজধানীর মধুবাগের ফুচকা বিক্রেতা মো. আমজাদের ক্ষেত্রেও। একসময় এক প্লেটে ৪টি ফুচকা বিক্রি করতেন ১০ টাকায়; এখন দাম একই আছে, কিন্তু সংখ্যা চারটি থেকে কমে দুটিতে নেমেছে।

পাড়া-মহল্লার দোকানে বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাবারের ক্ষেত্রেও সেই চিত্র দেখা যায়। দোকানিরা বলেন, মূলত ছোট আকারের যেসব বিস্কুট বা চিপসের প্যাকেট আছে, সেগুলোর দাম না বাড়িয়ে প্যাকেটের আকার বরং আরও ছোট করা হয়েছে। এই আকারের পণ্য সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়; এ জন্য এগুলোর দাম না বাড়িয়ে আকার ছোট করা হয়েছে।

দেড় বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে। এর মধ্যে গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। যদিও বিশ্লেষকেরা বলেন, বাস্তবে মূল্যস্ফীতি এর চেয়ে অনেক বেশি। এই পরিস্থিতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। উৎপাদক ও বিক্রেতারা সবকিছুর দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে আবার দাম না বাড়িয়ে পণ্যের আকার ছোট করেছেন বা ছোট ছোট ইউনিটে পণ্য বিক্রি করছেন। অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলে ‘শ্রিঙ্কফ্লেশন’।

শ্রিঙ্ক আর ইনফ্লেশন মিলে এই শব্দবন্ধ তৈরি করা হয়েছে। প্যাকেটজাত জিনিসের পরিমাণ কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলার কৌশল এটি। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বিপণন কর্মকর্তারা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্রয় ও বিপণন ব্যবস্থাপনা পড়ে বা ভোক্তা জরিপ করে এই কৌশল শিখে থাকেন। কিন্তু ফুটপাতের ফুচকা বিক্রেতার সেই পুঁথিগত শিক্ষা বা বিদ্যা নেই। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নিজের বুদ্ধিতে বিষয়টি তাঁর মাথায় গেঁথে গেছে—নগদ দাম বাড়ানোর বদলে ওজন কমিয়ে দিলে বেচাকেনা ঠিক রাখা যায়। ভোক্তার মন নিয়ে খেলা যায়।

বাংলাদেশের বাজারের চেহারা অনেকটা এ রকম: এখানে ক্রেতার সংখ্যা অনেক, কিন্তু বেশির ভাগেরই ক্রয়ক্ষমতা কম। যেসব জিনিস তাঁদের না কিনলেও চলে, এমন জিনিস তাঁদের দিয়ে কেনাতে হলে জিনিসের দাম শুধু তাঁদের নাগালের মধ্যে আনলেই হবে না; এই দাম যে মানুষের নাগালের মধ্যে, সেটা তাঁদের মাথায় ঢোকাতে হবে। বিজ্ঞাপনসহ প্রচারণার সব কৌশলের মাধ্যমেই দামের কথাটা বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়। সেই কৌশল কাজও করে। জানা যায়, সবচেয়ে কম দামি পণ্যে বিক্রি থেকে কোনো কোনো কোম্পানির মোট বিক্রির ৫০ শতাংশ, কোনো কোনো কোম্পানির ৭০ শতাংশ আসে। এ জন্য কম দামি পণ্যের সেই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টি অনেক কোম্পানি ভাঙতে চায় না।

বিপণনে প্রাইস অ্যাঙ্করিং বলে একটি ধারণা আছে। সেটা হলো, কোন জিনিসটার কত দাম, মানুষের মাথায় তার একটা হিসাব থাকে। এরপর কোনো জিনিস কেনার সময় মানুষ সেই দামের সঙ্গে নতুন জিনিসের দাম তুলনা করে দেখেন। যদিও দামের হিসাব স্বাভাবিকভাবে ওজন অনুযায়ী হওয়ার কথা; কিন্তু এই যে কোম্পানিগুলো আমাদের মাথায় ৫ বা ১০ টাকা দামের বিষয়টা ঢুকিয়ে দিয়েছে, তার সঙ্গে ওজনের হিসাব কিন্তু ঢোকায়নি।

চিপসের প্যাকেটের দামের অ্যাঙ্কর আমাদের মাথায় ১০ টাকা—সেই প্যাকেটে কত গ্রাম চিপস আছে, তা আমাদের হিসাবে নেই। আরেকটি বিষয় হলো, ‘সেক্রেড প্রাইস পয়েন্ট’, এটা এমন একটা দাম, যার অন্যথা হলে বিক্রি ধপ করে পড়ে যেতে পারে। আমাদের দেশের বাজারে চিপস বা রুটির ন্যূনতম দাম যদি হয় ১০ টাকা, তাহলে এই ১০ টাকা হলো বাজারের সেই সেক্রেড প্রাইস পয়েন্ট। কোম্পানিগুলো অবশ্য নিজেরাই এই প্রাইস পয়েন্ট তৈরি করে; আমাদের মাথায় তার অ্যাঙ্কর এত গভীরে ঢুকে গেছে যে সেখান থেকে সরলেই ক্রেতাদের মনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অনুভূতি গভীর হয়। এ জন্যই জিনিসের দাম অনেক কোম্পানি বাড়ায় না। কারওয়ান বাজারের সেই শিঙাড়া বিক্রেতাও জানেন, দাম পাঁচ টাকার বেশি হলে বিক্রি কমে যেতে পারে।

মানুষ স্বভাবতই ক্ষতি বিমুখ, বাংলাদেশ বা উন্নয়নশীল দেশের ক্রেতারা এ বিষয়ে আরও সংবেদনশীল। এ কারণে কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে দামের পয়েন্ট থেকে নড়া কঠিন। এ জন্য শ্যাম্পুর স্যাশের দাম বহুকাল এক জায়গায় স্থির ছিল। কিছু পণ্যের দাম বাড়ানো অতটা না হলেও মোটের ওপর কঠিন; আবার যেসব জিনিসের দাম ২০ টাকার ওপরে, সেই পণ্যের দাম দাম বাড়ানো খুব একটা কঠিন নয়।

প্যাকেটের আকার ছোট করার আরও কিছু সুবিধা আছে, যেমন প্যাকেট-পিছু ওজন কমানো হলে উৎপাদন খরচ কমে। তার ওপর এক ট্রাকে একই ওজনের মাল নেওয়া হলে প্যাকেটের সংখ্যা বেশি হয়; অর্থাৎ প্যাকেটপ্রতি পরিবহন ব্যয় কমে। পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতার কমিশন কমাতে হয় অনেক সময়। আবার কখনো এমন হয় যে সবচেয়ে কম দামের প্যাকেটের ক্ষেত্রে ক্ষতি স্বীকার করে বেশি দামের প্যাকেট বিক্রির লাভ দিয়ে সেটা পুষিয়ে নেওয়া হয়।

মূল্যস্ফীতি বিপুলসংখ্যক নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের জীবনে মূর্তিমান সংকট হয়ে আবির্ভূত হয়েছে
ফাইল ছবি : প্রথম আলো

সবকিছুর একটা সীমা থাকে; খরচ আরও বেড়ে গেলে দাম বাড়াতে হয়। একাধিক কোম্পানি একসঙ্গে দাম বাড়ালে মানুষও বাধ্য হয়ে অ্যাঙ্কর পাল্টায়; কিন্তু কোম্পানি সাধারণত তা করতে চায় না। বেশি দামি পণ্যের ক্ষেত্রে এটা সাধারণত করতে হয় না। কারণ, সচ্ছল মানুষের কাছে বিক্রি করার মতো আরও অনেক গল্প কোম্পানির কাছে থাকে, যেমন পুষ্টি, ফ্যাশন, লাইফস্টাইল ইত্যাদি।

দেশের বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূল্যস্ফীতির প্রভাব তাঁরা টের পাচ্ছেন। মানুষ বাজেট কমাচ্ছেন; ভোগের ধরনে আনছে পরিবর্তন। মূলত ক্রেতারা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রেখে ভোগের ধরন ঠিক করছেন। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন খেটে খাওয়া মানুষেরা। এর প্রভাব নিছক পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝা যাবে না। এই সমস্যা শ্রিঙ্কফ্লেশন দিয়ে মোকাবিলার চেষ্টা বিশেষভাবে কাজে আসে না। মাছের দাম বাড়লে এক কেজির বদলে আধা কেজি কিনে পকেট কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও বাস্তবে ভোগ কিন্তু কমছে। তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে নারী ও শিশুদের ওপর।