স্বল্প মেয়াদে অর্থনীতির সংকোচন হলেও দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীলতা জরুরি
পিএমআই সূচকের মান বেড়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সাময়িকভাবে চিন্তিত হলেও আমরা ব্যবসায়ীরা আত্মবিশ্ববাসী। এই দেশ ছাড়া আমাদের বিনিয়োগের ভিন্ন কোনো জায়গা নেই।
আমরা একটি বিশেষ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এই সময় ভোগ্যপণ্যের বাজারে ধীরগতি থাকবে বা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক ক্ষেত্রেই ধারণার ভিত্তিতে চলে। অনিশ্চয়তার মধ্যে তাই ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হয় না।
আমি মনে করি, সরকারের কিছু পদক্ষেপের কারণে আমরা স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছি। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত সংস্কারে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো ইতিবাচক। রাতারাতি কোনো পরিবর্তন হবে না। খেলাপি ঋণের যে পাহাড় জমেছে, ঋণের ঘাটতি ও সুদহার বৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগ ব্যাহত হবে। এমনকি কিছু সংকোচনও হতে পারে। স্বল্প মেয়াদে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীলতা আসা জরুরি।
আরেকটি বিষয়, গত ১৫ বছরে দেশে যে অলিগার্কি (গোষ্ঠীতন্ত্র) তৈরি হয়েছিল এবং যেভাবে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করত, তাতে ব্যবসা-বাণিজ্যে সমতা ছিল না। কিন্তু সবাই এর সঙ্গে জড়িত ছিল না। ফলে এখন আবার ঢালাওভাবে সবাইকে দোসর হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক হবে না। যাঁরা সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, তাঁরা দেশের বাইরে চলে গেছেন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হবে।
সরকার ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে হাত দিয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়িক সংস্কার প্রয়োজন। নতুন ব্যবসায়ীরা যেন ব্যবসা করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে। বড় ব্যবসায়ীদের সংগঠন ও প্রতিষ্ঠা আছে, তারা চাইলে লোক পাঠিয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু ছোট ব্যবসায়ীদের সেই সুযোগ নেই। তাঁদের যদি সব সময় সমস্যা সমাধান করতে হয়, তাহলে ব্যবসা করবেন কখন।
সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হলো, ব্যবসাবান্ধব নীতি প্রণয়ন করা। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নীতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নীতি ব্যবসাবান্ধব হলে ব্যবসা যেমন সহজ হতে পারে, তেমনি তার উল্টোও হতে পারে; এসব কারণে আমি বলব, নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও সংস্কার প্রয়োজন। যেমন এক বৈঠকে আমি বলেছি, নতুন যাঁরা ব্যবসা করতে আসছেন, তাঁদের পাঁচ বছরের জন্য কর মওকুফ করে দেওয়া হোক। তাঁরা তো চাকরি খুঁজছেন না, বরং চাকরি দিচ্ছেন। ফলে তাঁদের কিছু সুবিধা দেওয়া হলে মন্দ কী।
এ ছাড়া দেশের করব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল—এই প্রক্রিয়া সহজ করা জরুরি। ইতিবাচক বিষয় হলো, করব্যবস্থা সংস্কারে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি এই কমিটির এক বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে যে আলোচনা হয়েছে, আমার ভালো লেগেছে।
এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি হলো ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করা। তার জন্য দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। আমরা দেখছি, অনেক ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয়। মাঠের এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। জুলুম করার কথা বলছি না, কিন্তু যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
আরেকটি বিষয় হলো, কবে নির্বাচন হবে, তা জানা দরকার। সেটা জানানো হলে অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। নির্বাচনে কারা অংশগ্রহণ করবে আমরা জানি, কিন্তু বাস্তবতা হলো, কোন রাজনৈতিক দলের কী ইশতেহার, তা আমরা এখনো জানি না। ফলে নির্বাচনের রোডম্যাপ বা পথরেখা ঘোষণা করা হলে এসব নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতো; রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার নিয়ে আলোচনা হতো।
মোদ্দাকথা হলো, আমাদের ঝুঁকি হ্রাস করতে হবে।
আবুল কাশেম খান: সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি