সাক্ষাৎকার

ফাঁপা ব্লক ও পরিবেশবান্ধব ইট ব্যবহারে দূষণ কমানো সম্ভব

পরিবেশদূষণ ও নির্মাণ খাতের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছেন কনকর্ড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার কামাল। বলেছেন, পোড়ামাটির ইট ও ফাঁপা ব্লকের পার্থক্য নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রতীক বর্ধন

প্রথম আলো:

পরিবেশদূষণ হ্রাসে আপনাদের খাত কী ভূমিকা পালন করতে পারে?

শাহরিয়ার কামাল: প্রায়ই দেখা যায়, ঢাকা নগরের বায়ুর মান বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ। এতে বছরে দুই লাখের মতো মানুষের আগাম মৃত্যু হচ্ছে। ফুসফুসের রোগ বাড়ছে। আমাদের আয়ু সাত বছর কমে যাচ্ছে। যারা ঘরের বাইরে বেশি যাচ্ছে, যেমন শিশু, শ্রমিক, রিকশাচালক, এই শ্রেণির মানুষেরা সবচেয়ে আক্রান্ত হচ্ছে। এটা দুঃখজনক। এই বায়ু দূষণের ৬০ শতাংশ হচ্ছে ঢাকার আশপাশের ইটভাটার কারণে, যাদের অর্ধেকের লাইসেন্স নেই, পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। এই বাস্তবতায় ১৯৯৮ সাল থেকে কনকর্ড গ্রুপ পরিবেশবান্ধব ইট ও হলো ব্লক তৈরি করছে।

নির্মাণকাজে পরিবেশবান্ধব হওয়ার অনেক উপায় আছে, এর মধ্যে একটি হলো ভবনের জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো, পোড়ামাটির ইট ব্যবহার বন্ধ বা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে পরিবেশবান্ধব ইট ও ফাঁপা ব্লক ব্যবহার করা যায়, তাহলে এই এক ঘটনায় পরিবেশ দূষণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। শুধু কনকর্ড নয়, আরও অনেকেই এসব উৎপাদন করছে। সরকারি সংস্থা হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটও পরিবেশবান্ধব ব্লক নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে গবেষনা করেছে। কিন্তু এর ব্যবহার সেভাবে বাড়ছে না।

আমরা এই কারখানা করার পর সব প্রকল্পেই পরিবেশবান্ধব ইট বা ব্লক ব্যবহার করেছি, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হলো লেকসিটি কনকর্ড।
শাহরিয়ার কামাল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কনকর্ড গ্রুপ
প্রথম আলো:

দেশে তো অনেক দিন ধরেই ব্লক তৈরি হচ্ছে, সরকারও সময়-সময় এর ব্যবহার বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নিয়েছে, তারপরও কেন পরিবেশবান্ধব ইট বা ব্লক ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে না?

শাহরিয়ার কামাল: নতুন কোনো বিষয় মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে নিতে চায় না। মানুষের মনে শঙ্কা থাকে, নতুন কিছু ব্যবহারের কারণে সমস্যা হলে তার সমাধান কীভাবে হবে। এরপর রাজমিস্ত্রিদের এই ব্লক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ ছিল না, যেমন ইট লাগাতে হয় ভিজিয়ে, কিন্তু ব্লক লাগাতে হয় শুকনো অবস্থায়। জোড়া কীভাবে লাগাতে হবে, এসব অনেক বিষয় আছে। এসবের জন্য প্রশিক্ষণ দরকার। এ ছাড়া ইট চাইলেই পাওয়া যায়। ইটের অনেক শ্রেণিবিভাগ আছে, যেমন প্রথম শ্রেণির, দ্বিতীয় শ্রেণির, তৃতীয় শ্রেণির ইত্যাদি। এসব পাওয়া অনেক সহজ ও সস্তা-এটাকেই আমি মূল কারণ বলব। তবে আমরা এই কারখানা করার পর সব প্রকল্পেই পরিবেশবান্ধব ইট বা ব্লক ব্যবহার করেছি, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হলো লেকসিটি কনকর্ড। পুরো প্রকল্পই পরিবেশবান্ধব ইট, ব্লক ও টাইলস দিয়ে তৈরি। ফলে আমরা ২০২১ সালে সরকারের পরিবেশবান্ধব পুরস্কার পাই।

চীন ও ভারতেও এই জিনিস ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা যে কৌশল গ্রহণ করেছে, আমাদেরও তা নিতে হবে-বস্তুত তা নেওয়াও হয়েছিল। সেরা সমাধান হলো, পুরো বিষয়টি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করে তোলা, এবং সে লক্ষ্যে প্রণোদনা দেওয়া। যে বা যার কারণে দূষণ হচ্ছে, তাকে শাস্তি দেওয়া। যেসব ইটের ভাটা পুরোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তাদের অন্তত আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণে চাপ দেওয়া। ব্যবহার বাড়াতে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া, যদিও যতই প্রণোদনা দেওয়া হোক না কেন, চাহিদা না বাড়লে বিষয়টি লাভজনক হবে না। চাহিদা বাড়াতে সরকারি প্রকল্পে পরিবেশবান্ধব ইট ও ব্লকের ব্যবহার করতে হবে। রাতারাতি তা হবে না; দীর্ঘদিন ধরে তা করা যেতে পারে। অনেক উদ্যোক্তা কিন্তু এই খাতে এসেছেন, কিন্তু চাহিদা না থাকায় কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। সরকারও ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে অবকাঠামো তৈরিতে ১০ শতাংশ পরিবেশবান্ধব ইট ব্যবহারের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে নির্মাণে খাতে শতভাগ পরিবেশবান্ধব ইট ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছিল তৎকালীন সরকার। কিন্তু পর্যবেক্ষণের অভাবে এসব বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সেই সিদ্ধান্ত আবার বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে রাজউকের মাধ্যমে বেসরকারি খাতকেও এসব উপকরণ ব্যবহারের লকত্ষ্যমাত্রা দেওয়া। ধাপে ধাপে লক্ষ্যমাত্রা দিতে হবে। এসব বিষয় পর্যবেক্ষণে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করতে হবে। বাস্তবতা হলো, আমরা প্রতি আট ঘণ্টায় দুই লাখ পিছ পরিবেশবান্ধব, ইট, ব্লক ও টাইলস তৈরি করতে পারি, কিন্তু চাহিদা না থাকায় এখন চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে না।

আরেকটি বিষয়, পোড়ামাটির ইট তৈরি করতে গিয়ে প্রতি বছর মাটির উপরিভাগের এক শতাংশ নষ্ট হচ্ছে; এটা অনেক বেশি।

প্রথম আলো:

ব্যয়ের বিষয়টি একটু বলবেন; ব্লক দিয়ে ভবন নির্মাণ অধিক সাশ্রয়ী হবে নাকি পোড়ামাটির ইট দিয়ে?

শাহরিয়ার কামাল: ব্যয়ের বিষয়টি নির্ভর করে ব্যবহারের ওপর, সেই সঙ্গে বাজারের প্রতিযোগিতার ওপর। সরকার যদি এই ব্লক ব্যবহার শুরু করে বা আরও ১০০টি কারখানা এই ব্লক নির্মাণে এগিয়ে আসে, তাহলে যেমন এর প্রাপ্যতা বাড়বে, তেমনি দামও কমে আসবে। অর্থনীতির নিয়মেই তা কমে আসবে। পাঁচটি ইটের সমান একটি ব্লক। এই মুহূর্তে কেউ যদি ভবন নির্মাণ করতে চান, শুরু থেকেই যথাযথভাবে নকশা করা হলে খরচ কিছুটা কম পড়বে।

প্রথম আলো:

এই ব্লক বাজারে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে ইট ভাটার মালিকদের বিরোধিতার মুখে পড়েছেন কি আপনারা?

শাহরিয়ার কামাল: প্রাথমিকভাবে বিরোধিতার মুখে পড়েছি। আমরা কিন্তু বলছি না যে ইটের ভাটা একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে। বলছি, দূষণ কমাতে হবে। মানুষ যখন বুঝতে পারবে, ভাটার কারণে কী হচ্ছে, তখন তারাও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণে বাধ্য হবে। অনেকেই এই ব্যবস্থা নিয়েছে।

প্রথম আলো:

ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এসব ব্লক কতটা সহনীয়?

শাহরিয়ার কামাল: যেকেনো সাধারণ ইটের তুলনায় হলো বা ফাঁপা ব্লক দিয়ে তৈরি ভবনের ওজন অনেক কম হয়, যদিও মজবুত। স্বাভাবিকভাবেই হালকা ভবন ভূমিকম্প ও দুর্যোগের সময় বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। ভূমিকম্পের সময় সাধারণত দেয়াল ভেঙে গিয়ে মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু ফাঁপা ব্লক দিয়ে তৈরি ভবনে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব, যে কারণে ভবন ভেঙে পড়ার সম্ভবনা কম।