সাক্ষাৎকার

গ্রামাঞ্চলে ঋণ বিতরণে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে অগ্রণী ব্যাংক

দেড় বছর ধরে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. মুরশেদুল কবীর। এর আগে তিনি সোনালী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। সম্প্রতি তিনি অগ্রণী ব্যাংক ও ব্যাংক খাতের বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব

প্রথম আলো:

প্রায় দেড় বছর হয়েছে আপনি অগ্রণী ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অগ্রণী ব্যাংক কেমন করছে?

মুরশেদুল কবীর: বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরাজমান অস্থিতিশীলতার প্রভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রতিকূল এক পরিস্থিতিতে আমি অগ্রণী ব্যাংকে যোগদান করি। এরপর নানা প্রতিকূলতা উত্তরণে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করি। এসব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে বিভিন্ন সূচকের উন্নতিও হয়েছে। ২০২২ সালের আগস্টে আমি যোগ দিই। এরপর কয়েক মাসের ব্যবধানে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকের আমানত ১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা বেড়ে ৯৩ হাজার ৭৭ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০২৩ সালে তা আরও বেড়ে হয়েছে ৯৮ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। পাশাপাশি ঋণও বেড়েছে। এর ফলে ২০২৩ সালে আমরা ১ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছি, যা অগ্রণী ব্যাংকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ওই বছর রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিচালন মুনাফা করেছিল অগ্রণী ব্যাংক। এ ছাড়া রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রবাসী আয় আহরণে শীর্ষে ছিল অগ্রণী ব্যাংক। গত বছর পুরো ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট ছিল, যার প্রভাব অগ্রণী ব্যাংকেও পড়ে। তবে নতুন নতুন আমানত পণ্য চালুসহ নানা পদক্ষেপের ফলে আমানতের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে।

বিদ্যুৎ অবকাঠামোসহ শিল্প ও বাণিজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে অগ্রণী ব্যাংক।
মুরশেদুল কবীর,এমডি, অগ্রণী ব্যাংক
প্রথম আলো:

অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ গ্রাহকদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যবসা সফল, আবার বিতর্কিত অনেকেও আছেন। গ্রাহকদের নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

মুরশেদুল কবীর: দেশের ব্যাংক খাতে বড় বড় কিছু আর্থিক অনিয়মের খবর শোনা গেলেও অগ্রণী ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য কোনো অনিয়মের কথা বাজারে প্রচারিত নেই। কারণ, আমরা কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন খাতের ছোট, বড় ও স্বনামধন্য উদ্যোক্তাদের সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও পেশাদারির সঙ্গে ঋণ বিতরণে সচেষ্ট।

প্রথম আলো:

একসময় বড় ঋণ মানেই ছিল অগ্রণী ব্যাংক। একসময় আগ্রাসী ব্যাংকিংয়েরও খ্যাতি পেয়েছিল। এখন কি অন্য পথে ফিরেছে?

মুরশেদুল কবীর: বড় ঋণ এখন খুবই কম দেওয়া হচ্ছে। আগের ঋণগ্রহীতাদের কারও চলতি মূলধন লাগলে সে ক্ষেত্রে দেওয়া হচ্ছে। আমরা অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে ঋণ বাড়াচ্ছি। শহর ও গ্রামের ব্যবধান কমিয়ে আনতে গ্রামাঞ্চলে ঋণ বিতরণ বাড়াতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। এ জন্য প্রতিটি শাখাকে লক্ষ্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে আমাদের রয়েছে ৯৭৭টি শাখা ও ৫৬৭টি এজেন্ট ইউনিট। এ ছাড়া দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও অবকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে অগ্রণী ব্যাংক। বিদ্যুৎ অবকাঠামোসহ শিল্প ও বাণিজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে অগ্রণী ব্যাংক। এটিকে আগ্রাসী ব্যাংকিং বলা যাবে না। অগ্রণী ব্যাংক ৯৮টি শিল্প প্রকল্পে ঋণ প্রদান করেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এ ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণে অগ্রণী ব্যাংক এককভাবে ১৪৫ কোটি ডলার সরবরাহ করেছে।

প্রথম আলো:

কিন্তু আপনাদের খেলাপি ঋণ তো বাড়ছে। খেলাপি ঋণ ২৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

মুরশেদুল কবীর: যেসব ঋণ খেলাপি হয়েছে, সেগুলো আমার সময়ে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া করোনার দুই বছরে ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে একটা ধাক্কা এসেছে। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ কমিয়ে দিয়েছেন। এই কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে আমরা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঋণ আদায়ে পদক্ষেপ নিয়েছি। এককালীন পরিশোধ সুবিধা ও পুনঃ তফসিল করে খেলাপি কমানো হচ্ছে। নতুন করে যাতে কোনো ঋণ খেলাপি না হয়, সে জন্য পদক্ষেপ নিয়েছি।

প্রথম আলো:

২০২০ সালে সুদহার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন আবার কিছুটা বাজারভিত্তিক হয়েছে। তারল্য ব্যবস্থাপনায় কেমন প্রভাব পড়েছে?

মুরশেদুল কবীর: একক অঙ্কের সুদহারের সীমা থেকে সরে এসে নতুন ব্যবস্থার মাধ্যমে সুদহারকে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এতে আমানতকারীরা উচ্চ হারে সুদ পেয়ে সঞ্চয়ে উৎসাহী হচ্ছেন। এর ফলে আমানত বাড়ছে। অন্যদিকে ঋণের সুদের হারও কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুদের হার বাজারভিত্তিক হওয়ায় দেশের ব্যাংকিং খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

প্রথম আলো:

দুই বছর ধরে দেশে ডলার–সংকট চলছে। এই সংকট কীভাবে সামাল দিচ্ছেন?

মুরশেদুল কবীর: আমাদের ব্যাংকের করপোরেট ও সরকারি খাতের গ্রাহকেরা বৈদেশিক মুদ্রা জোগানে এগিয়ে এসেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপের কারণে ডলারের দাম অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফলে এখন বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিও অনেক কমে গেছে। ব্যাংক গ্রাহকদের চাহিদা ও গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমদানি দায় পরিশোধ করছে। গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান নিশ্চিতে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছি।

প্রথম আলো:

ব্যাংক খাতে এখন বড় আলোচনা দুর্বল ব্যাংক একীভূত হওয়া। দুর্বল ব্যাংক একীভূত হলেই কি ব্যাংক খাতের সংকট কেটে যাবে?

মুরশেদুল কবীর: একীভূতকরণ প্রক্রিয়া নতুন কোনো বিষয় নয়। দেশে-বিদেশে এ ধরনের উদ্যোগের অনেক উদাহরণ আছে। দুর্বল ব্যাংক একীভূত হলে উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ঝুঁকি ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমবে। এই প্রক্রিয়া আমানতকারীদের স্বার্থ এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে। তবে ব্যাংক খাতের সংকট কাটাতে এটিই একমাত্র সমাধান নয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ নিয়ন্ত্রণ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর তদারকি ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।