ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণে প্রয়োজন সরকারের কার্যকর উদ্যোগ
ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য বিভিন্ন বৃহৎ আবাসন প্রকল্পের ভূমিকার কথা বলা হয়। বিকেন্দ্রীকরণ বা ডিসেন্ট্রালাইজ হচ্ছে মূলত কোনো একটি বৃহৎ প্রকল্পকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে বিস্তৃত ও ব্যাপৃত করা। অর্থাৎ কোনো শহরকে এককেন্দ্রিক না রেখে একাধিক অঞ্চলে স্থানান্তর করা এবং নবগঠিত অঞ্চলকে সব দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে গড়ে তোলা।
ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য জলসিঁড়ি, বসুন্ধরা, উত্তরা তৃতীয় ধাপ ও পূর্বাচল প্রকল্পগুলোর দিকে তাকালে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে এই প্রকল্পগুলো যথাযথভাবে বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে কি না। উল্লিখিত প্রকল্পগুলোতে অবকাঠামোগত সহায়তা যদি যথেষ্ট পরিমাণ থাকে; অর্থাৎ বাসিন্দাদের বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কোনো কিছুর জন্য ঢাকার অন্য অংশের সহযোগিতার প্রয়োজন না হয়, তাহলে বুঝতে হবে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ এগিয়ে যাচ্ছে। বিকেন্দ্রীকরণ হলে শিক্ষা, চিকিৎসা ও যেকোনো কেনাকাটাসহ অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা ওই এলাকাতেই থাকবে। আর যদি দেখা যায়, এসব প্রকল্প এলাকার বাসিন্দাদের কোনো কাজের জন্য ঢাকার অন্য কোনো অংশে যেতে হচ্ছে, তাহলে ধরে নিতে হবে বিকেন্দ্রীকরণ যথাযথভাবে এখনো সম্পন্ন হয়নি। অর্থাৎ নাগরিকদের প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুই তখনো কেন্দ্রের মধ্যেই রয়ে গেছে। এ রকম অবস্থাকে কোনোভাবেই বিকেন্দ্রীকরণ বলা যায় না।
বিকেন্দ্রীকরণের মূল উদ্দেশ্যই হলো, অবকাঠামোর উন্নয়ন করে তা যথোপযোগী করে গড়ে তোলা। জলসিঁড়ি প্রকল্পের কথা ধরা যাক। যদি এই প্রকল্পের অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হয়, তাহলে সেখানকার যোগাযোগব্যবস্থা থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যাবতীয় কেনাকাটা, ব্যবসায়ের সুযোগ প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এসব সুবিধা নিশ্চিতের পর জলসিঁড়ির বাসিন্দাদের যদি মনে হয় যে কোনো সুযোগ-সুবিধার জন্য তাঁদের আর অন্যত্র যাওয়ার প্রয়োজন নেই, তবেই কেবল বলা যাবে ওখানে বিকেন্দ্রীকরণটা যথাযথভাবে হয়েছে।
জলসিঁড়ির মতো একইভাবে উত্তরা তৃতীয় ধাপ, বসুন্ধরা ও পূর্বাচল প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই প্রসঙ্গ আসবে। তবে অপ্রিয় হলেও সত্য যে সরকারের একটি বৃহৎ প্রকল্প হিসেবে পূর্বাচল এখনো ঠিকভাবে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। এখানে বহুদিন ধরে উন্নয়নকাজ চললেও এখনো তা পূর্ণতা পায়নি। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধাগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সহজভাবে বললে পূর্বাচল নিয়ে এখনো আমরা তেমন একটা আশার আলো দেখতে পাইনি। এখানে সুবিধাগুলো যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ অনেকটাই সফলতার মুখ দেখবে।
আমরা চাই প্রতিটি আবাসন বা হাউজিং প্রকল্পই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে গড়ে উঠুক, যেন সেখানকার কোনো নাগরিককেই বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া অন্য আরেকটি প্রকল্প কিংবা মূল ঢাকায় যেতে না হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, কেনাকাটাসহ সরকারি অনেক প্রশাসনিক অংশও থাকতে পারে এসব প্রকল্পে। আর সেটি করা গেলে বিকেন্দ্রীকরণ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হবে।
একজন ক্রেতা হাউজিং কোম্পানির তৈরি একটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে ওই স্থানে তার প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুবিধা প্রত্যাশা করেন। অবকাঠামোগত সহায়তাগুলো সহজে পেতে চান। অ্যাপার্টমেন্টের একজন ক্রেতা চান তাঁর সন্তান যেন সহজেই শিক্ষার সুবিধা পায়। তাঁর যোগাযোগ যেন সহজ হয়। অর্থাৎ তাঁর নিত্যদিনের চাহিদাগুলো কত সহজে পূরণ হয়, সেই লক্ষ্য থাকে। এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। সেটি হলো বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্প, যা সব ধরনের সুবিধা বিবেচনায় অনেক এগিয়ে রয়েছে। এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিপণিবিতান, বিনোদনসহ নানাবিধ অবকাঠামো উন্নয়ন সম্পন্ন হয়েছে। তবে বসুন্ধরার মতো অন্য এলাকাগুলোয় এখনো যথাযথভাবে উন্নতি ঘটেনি। আমি মনে করি, নতুন অন্যান্য প্রকল্পও যদি অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে, তাহলে হাউজিং কোম্পানিগুলোর ব্যবসার প্রসার ঘটবে।
জলসিঁড়ি, উত্তরা তৃতীয় ধাপ ও পূর্বাচলের মতো প্রকল্পগুলো ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে সরকারের বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। আমরা চাই সরকারের এসব বৃহৎ পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন। এই বৃহৎ প্রকল্পগুলোতে বেসরকারি উদ্যোগে খুব বেশি আশানুরূপ ফল যে দেবে না, এটি সবাই অনুধাবন করেন। ফলে এখানে সরকারকেই আন্তরিকভাবে সব ধরনের সুবিধা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রকল্পগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে হাউজিং কোম্পানিগুলো একদিকে নাগরিকদের পর্যাপ্ত সুবিধা দিতে পারবে, অন্যদিকে তাদের ব্যবসারও প্রসার ঘটবে।
ঢাকার অভ্যন্তরে জমির স্বল্পতার বিষয়ে সবাই অবগত। বর্তমানে ঢাকায় জমির স্বল্পতা পূর্বাচলসহ নতুন প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব। আমরা মনে করি, দেশের একটি বড় অংশের নাগরিক গোষ্ঠীকে মানসম্পন্ন আবাসন সুবিধা দিতে জরুরি ও অগ্রাধিকারভিত্তিতে ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
জিল্লুল করিম
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ক্রিডেন্স হাউজিং