সংকট কতটা গভীর, তা বোঝার মত অবস্থায় আমরা নেই

জাহিদ হোসেনফাইল ছবি

সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে এমন কোনো খাত নেই, যেখানে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়েনি। এই পরিস্থিতির শেষ আমরা দেখিনি। কোথায় গিয়ে শেষ হবে, তা–ও আমরা জানি না। সব মিলিয়ে চরম এক অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে।

মাঠের ফসলের এখন হয়তো ক্ষতি হচ্ছে না। কিন্তু ফসলের যত্ন নেওয়ার জন্য যেসব জিনিসের প্রয়োজন, সেগুলোর সরবরাহ না থাকলে একসময় ফসলেরও ক্ষতি হবে।

বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি এরই মধ্যে বাংলাদেশের ঋণমান অবনমন করেছে। এই প্রতিবেদনে তারা কিন্তু জুলাই মাসের পরিস্থিতি আমলে নিতে পারেনি; তা সত্ত্বেও এই অবনমন। সেখানে তারা দেশের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কথা বলেছে। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে না বলে জানিয়েছে তারা।

সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে ইন্টারনেট বন্ধ রাখল। অথচ এখন ইন্টারনেট ছাড়া মানুষের একমুহূর্ত চলে না। এতে যে শুধু আমাদের ফ্রিল্যান্সার বা ই-কমার্স, এফ-কমার্স ব্যবসায়ীদের আয়ের পথ বন্ধ হয়েছে তা নয়; বরং বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশের ভাবমূর্তিও বিনষ্ট হয়েছে। এই ভাবমূর্তি কীভাবে ফেরানো যায়, সেই কৌশল প্রণয়নের সময় এখনো আসেনি।

আড়াই বছর ধরেই দেশের অর্থনীতি চাপের মুখে রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সংকট, খেলাপি ঋণ নিয়ে সমস্যা, জ্বালানির উচ্চ মূল্য, বিনিয়োগ সংকট, অপ্রতুল কর্মসংস্থান—এসব সমস্যা অনেক দিন ধরেই বিষফোড়ার মতো হয়ে আছে। ছয় মাস আগেও মনে হচ্ছিল, এই সংকটের তলানি দেখা যাচ্ছে না। তবে দুই-তিন মাস ধরে মনে হচ্ছে, তলানিটা বোধ হয় দেখা যাচ্ছে। প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয়, রাজস্ব আয়—এসব ক্ষেত্রে কিছু উন্নতি হচ্ছিল। তবে দুর্দশা ছিলই। কিন্তু ওই যে বললাম, তলানিটা দেখা যাচ্ছিল। এখন আর তা দেখা যাচ্ছে না; সংকট কতটা গভীর, তা বোঝার মতো অবস্থায় আমরা নেই।

শরীরে রক্তক্ষরণ হলে অন্যান্য রোগ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। অথবা আগে থেকে রোগ নির্ণয় হয়ে থাকলেও ওষুধে কাজ হবে না; শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে গেলে তো ওষুধ খেয়ে কাজ হবে না। এখন তো আক্ষরিকভাবেই শরীরের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সেই সঙ্গে চলছে সামাজিক রক্তক্ষরণ।

মোদ্দাকথা হলো, এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে কথা বলার অর্থ হয় না। মূল বিষয় হলো, রাজনৈতিক সমাধান—সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান। সবার ক্ষোভ আমলে নিয়ে সমাধান বের করতে হবে। দমন-পীড়নের অবসান ঘটাতে হবে। কেউ যদি দাবি করেন, এ সংকটের সমাধান না করেও অর্থনৈতিক নীতি-কৌশল প্রণয়ন করা সম্ভব, তিনি মিথ্যা বলছেন।

জাহিদ হোসেন: বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ।