প্রথম আলো: পূবালী ব্যাংক যে উদ্দেশ্যে পুনর্গঠন হয়েছিল, সেই পথেই চলছে নাকি লক্ষ্য–উদ্দেশ্য পরিবর্তন হয়েছে?
মোহাম্মদ আলী: পূবালী দেশের প্রথম বাঙালি ব্যাংক। এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৯ সালে, ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক নামে। তখন পাকিস্তানিরা মূলত ঋণ পেত। এ জন্য বাঙালিদের ঋণ দিতে এই ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু নিজেই এই ব্যাংকের নাম দেন পূবালী ব্যাংক। এরপর একসময় ব্যাংকটি দুর্বল ব্যাংকের তালিকায় চলে যায়। ১৯৮৪ সালে বেসরকারি খাতে পূবালী ব্যাংক নবযাত্রা শুরু করে। তখন খেলাপি ঋণের হার ছিল ৫৪ শতাংশ। সম্পদ ছিল সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা। এরপর ধীরে ধীরে পুনর্গঠন হয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির পুনর্গঠন চলে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক ব্যাংকটিতে ছিলেন। ব্যাংকটির পুনর্গঠনে মানবসম্পদের মান উন্নয়ন ও জনবলের মানসিকতা পরিবর্তন ছিল প্রধান কাজ। উদ্দেশ্য গ্রাহকবান্ধব সেবা চালু করা। দুর্নীতি যেন কোনোক্রমেই না হয়, সেটাও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। নতুন করে কোনো ঋণ যাতে খেলাপি না হয়, তা অর্জন করে সুশাসন নিশ্চিত করা ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। ২০০৭ সালের পর লক্ষ্য আরও কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। ধীরে ধীরে উন্নতির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় এবং তা অর্জন হয়। ২০১২ সালে নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, যাতে একজন ব্যক্তিকে পুরো জীবনে সেবার আওতায় রাখা যায়। এ জন্য সব শাখাকে নতুন রূপ দেওয়া হয়। নতুন দক্ষ কর্মী নিয়োগ, প্রতি দুই বছর পরপর নতুন স্কেল নির্ধারণ, কম্পিউটার ল্যাব স্থাপনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। করোনার সময়েই কর্মীদের স্কেল ৩০ শতাংশ বেতন বাড়ানো হয়। এখন বেতন প্রদানে শীর্ষ দুই–তিনটি ব্যাংকের একটি পূবালী। পুরোনো ব্যাংক হলেও আমাদের ৮০ শতাংশ কর্মী ৪০ বছরের নিচে। কোনো গ্রাহক যেন সেবা নিতে এসে ফেরত না যান, তা নিশ্চিত করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে ভালো সাজসজ্জার ব্যাংকগুলোর মধ্যে পূবালী অবশ্যই একটি। পাশাপাশি ব্যাংকে প্রযুক্তির যত ব্যবহার করা যায়, তা করেছি। ফলে অনলাইন লেনদেনে শীর্ষ ব্যাংকের একটি পূবালী। আমাদের এখন বড় লক্ষ্য গ্রাহকের দোরগোড়ায় ব্যাংক–সেবাকে নিয়ে যাওয়া। ঋণ প্রস্তাব, ঋণপত্র খোলা, সবই আমরা গ্রাহকের কাছে নিয়ে যেতে চাই। এ জন্য ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সব প্ল্যাটফর্ম আমরা প্রস্তুত করছি।
প্রথম আলো: ২০০৮ সালে প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা হিসেবে ব্যাংকে যোগদান। এরপর ১৫ বছরের মধ্যে ব্যাংকের শীর্ষ পদের দায়িত্বে। পূবালী ব্যাংক কি এ জন্য প্রযুক্তিতে বাড়তি মনোযোগ পেয়েছে?
মোহাম্মদ আলী: ২০০৮ সালে যোগ দিয়েই আমি কোর ব্যাংকিং সল্যুশন (সিবিএস) স্থাপনের কাজ শুরু করি। ওই বছরে ১০ শাখায় সিবিএস স্থাপন সম্পন্ন হয়। ২০১৪ সালের মধ্যে সব শাখা অনলাইনের আওতায় চলে আসে। ফলে প্রতিটি সূচকে পূবালী ব্যাংকের উন্নতি হয়েছে। ১৯৮৪ সালে সাড়ে ৮০০ কোটি টাকার সম্পদ পরিচালনার জন্য লোকবল ছিল ৯ হাজার। এখন ৭২ হাজার কোটি টাকার সম্পদও দেখভাল করছেন ৯ হাজার কর্মী। প্রযুক্তির কল্যাণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া গত পাঁচ-ছয় বছরে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে, তার এক টাকাও এখন পর্যন্ত খেলাপি হয়নি। কারণ, ১০ কোটি টাকার বেশি ঋণে শাখা ও প্রধান কার্যালয় থেকে পরিদর্শন করা হয়। আর ১০০ কোটি টাকার বেশি ঋণে এমডি বা ক্রেডিট কমিটির চেয়ারম্যান পরিদর্শন করেন। ফলে পূবালী ব্যাংকে কোনো ‘ব্রিফকেস কোম্পানি’র ঋণ নেই।
অন্যান্য ব্যাংক যখন আমানত হারিয়ে সংকটে, তখন আমাদের আমানত বেড়েছে। ডিসেম্বরে আমানত ছিল ৫১ হাজার কোটি টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা।মোহাম্মদ আলী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পূবালী ব্যাংক
প্রথম আলো: পুরোনো ও বড় করপোরেটরা পূবালী ব্যাংকের গ্রাহক। ডলার নিয়ে এক বছর ধরে দেশে সংকট চলছে। এখন অনেক ব্যাংক টাকার সংকটেও পড়েছে। আপনারা কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন। গ্রাহকেরা কেমন করছে?
মোহাম্মদ আলী: আমাদের ব্যাংকে টাকার কোনো সংকট নেই। আমরা দুই বছরে ১৫১টি উপশাখা খুলেছি। সারা দেশে ৫০০ শাখা রয়েছে। সব শাখায় ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হচ্ছে। আমরা ভালো আমানত পেয়েছি। অন্যান্য ব্যাংক যখন আমানত হারিয়ে সংকটে, তখন আমাদের আমানত বেড়েছে। ডিসেম্বরে আমানত ছিল ৫১ হাজার কোটি টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা। আমাদের ইসলামি শাখায় আমানত ১ হাজার ৩৫৬ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা।
ডলারের ক্ষেত্রে আমরাও খুব সতর্কভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে যাচ্ছি। ২০২২ সালে একজন গ্রাহককে যত ডলার দিয়েছি, এখনো সেই পরিমাণ দিচ্ছি। কাউকে বেশি ডলার দেওয়া হচ্ছে না। আমরা অন্য ব্যাংকের দায়ও নিচ্ছি না। ডলারের কারণে বড় করপোরেটরা একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। অনেকে পণ্য এনেছিল বাকিতে, সেই পণ্য বিক্রি করে দিয়েছে। পরে পণ্যের দাম পরিশোধের সময় ডলারের দাম বেড়ে গেছে। তবে আমাদের কোনো গ্রাহক কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। তাই আমাদের ব্যাংকে খেলাপির হার এখন ২ দশমিক ৬২ শতাংশ। আমরা গ্রাহককে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করি, গ্রাহকও আমাদের কিস্তি নিয়মিত রেখেছে। বাড়তি প্রবাসী আয় আনতে আমরা পুরস্কারও চালু করেছি।
প্রথম আলো: এসএমই খাতেও আপনাদের ভালো বিনিয়োগ আছে। এই সময়ে এসএমই খাত কেমন করছে?
মোহাম্মদ আলী: আমাদের মোট ঋণের ২৬ শতাংশ এসএমই খাতে। বর্তমান পরিস্থিতিতেও তারা ভালো করছে। এসএমই খাতে আমাদের খেলাপি ঋণের হার ২ শতাংশের নিচে। মূল্যস্ফীতি বাড়লেও বিক্রি বেড়েছে। ফলে আমাদের ঋণ নিয়মিত আছে।
প্রথম আলো: সুদহার নিয়ে একটা বড় আলোচনা চলছে। ভোক্তা ঋণে সুদ বাড়ছে। অন্য ঋণের সুদহারেও নতুন নিয়ম চালু হচ্ছে। সুদের বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
মোহাম্মদ আলী: আমরা ভোক্তা ঋণে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিচ্ছি। তবে এসএমই খাতের উদ্যোক্তা ও করপোরেটদের ঋণের সুদ ৯ শতাংশই অনেক বেশি। আমরা এখনো অনেক গ্রাহক থেকে ৭, সাড়ে ৭ ও ৮ শতাংশ সুদ নিচ্ছি। নতুন করে সুদহার নির্ধারণ করা হলেও আমরা গ্রাহক পর্যায়ে সুদহার বাড়াব না। কারণ, এতে গ্রাহক অস্বস্তিতে পড়বে। ঋণে খারাপ প্রভাব পড়বে। আমরা এখনো কম সুদে আমানত পাচ্ছি। সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদেও আমানত নিয়েছি। সামনে আমানত বাড়াতে নতুন সেবা আনব। ডিজিটাল সেবার সব প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুত করে রেখেছি। ফলে ডিজিটাল নতুন যেকোনো সেবায় পূবালী ব্যাংক সব সময়ই এগিয়ে থাকবে।
প্রথম আলো: পূবালী ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং সেবায় কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
মোহাম্মদ আলী: গত বছরের এপ্রিলে ইসলামি ব্যাংকিং সেবায় আমানত ছিল ৭৪০ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে ১১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও ১০৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮৭ শতাংশ। আমাদের ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, প্রথম বাঙালি ব্যাংক, সুনামের কারণে আমরা ইসলামি ব্যাংকিং সেবায় ভালো করব বলে আশাবাদী।