স্বস্তির আর কোনো জায়গা থাকল না

ড. সেলিম রায়হান

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময়ও বলেছি, এবারও বলছি, গ্যাসের দাম বাড়ানোর এটা সঠিক সময় নয়। এমনিতেই এখন দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি। শিল্প পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে তা আরও বাড়তে পারে।

দেশের শিল্পকারখানাগুলো হয়তো শুরুতে অভ্যন্তরীণভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর চাপ মোকাবিলার চেষ্টা করবে। কিন্তু তা না পারলে তারা শেষমেশ ভোক্তাদের কাঁধেই এই দায় চাপিয়ে দেবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর সবকিছুর দাম বেড়েছিল। গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পর তা আবারও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছি।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সময় বিশ্ববাজারে দাম অনেক বেশি ছিল। এখন কিন্তু তা ৪০ শতাংশের মতো কমে এসেছে। তারপরও দাম সমন্বয় করা হচ্ছে না, অর্থাৎ কমানো হচ্ছে না। উল্টো এখন গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো—অনেকটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। শিল্প বা ব্যক্তি মানুষকে কোনো দিক থেকেই স্বস্তি দেওয়া হচ্ছে না। এটাই উদ্বেগের বিষয়।

জ্বালানির ক্ষেত্রে আমাদের গ্যাসনির্ভরতা বেশি। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে আমদানি করা এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। বেড়েছে ভর্তুকি। চলমান সামষ্টিক অর্থনীতির চাপের কারণে সরকারের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। একই সঙ্গে আইএমএফের শর্ত মানার বিষয় আছে।

আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে পারিনি। জ্বালানির ক্ষেত্রে আমরা ৯৭ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। মাত্র ৩ শতাংশের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি আছে আমাদের। জ্বালানির এই কাঠামো কোনোভাবেই টেকসই নয়। গত ৮-১০ বছরে আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বাড়াতে পারিনি। ফলে সরকার এখন বলছে, উপায় নেই।

সব ধরনের শিল্পের জন্যই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। আমি বলব, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের জন্য দাম আরেকটু কম রাখা যেত কি না, সেটা ভেবে দেখা উচিত ছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন কর ও শুল্ক সমন্বয় করে আরেকটু কম হারে দাম বাড়ানো যেত—এতটা একবারে না বাড়িয়েও। অর্থাৎ অন্যান্য উপায়ে সমন্বয় করা যেত কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত ছিল।

অন্যদিকে গ্যাসের দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। কারণ, এলএনজি তো দেশের বাজার থেকে টাকায় কেনা হবে না। বিদেশ থেকে ডলারেই কিনতে হবে। ফলে টাকায় দাম বাড়িয়ে ডলারে মূল্য পরিশোধ করা তো সম্ভব হবে না। ডলারের সংকট রয়েছে। কয়লার অভাবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রেও এক মাসের মতো কয়লা আছে। এলসি খুলতে পারছে না তারা। সমস্যা একটাই, ডলার-সংকটের কারণে আমদানি সীমিতকরণ নীতি। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আবারও ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ব আমরা।

সরকার বাজেট ঘাটতিতে আছে। নানা জায়গা থেকে তাকে ঋণ করতে হচ্ছে। জ্বালানির দাম বাড়িয়ে সরকার হয়তো সেই ঘাটতি কিছুটা মোকাবিলা করতে পারবে। কিন্তু শেষমেশ এটা নিশ্চিত করতে হবে যে শিল্প গ্যাসের সরবরাহ পাচ্ছে। কয়েক মাস আগে ব্যবসায়ীরাও দাবি করেছেন, উচ্চ দামে হলেও তাঁদের নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হোক। তাঁরা শেষ পর্যন্ত এই নীতিতেই হয়তো অটল থাকবেন। কারণ, গ্যাস না থাকলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে থাকবে।

আমিও প্রধানত গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়ে উদ্বিগ্ন। সরকার দাম বাড়ানোর সময় যদি বলত, কীভাবে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে, তাহলে ভালো হতো। এখন দাম বাড়ল, কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত হলো না, তাহলে তো হবে না।

লেখক: সেলিম রায়হান
নির্বাহী পরিচালক, সানেম