ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি গ্রামীণ ব্যাংক শুরু করে কীভাবে?
নূর মোহাম্মদ: ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে তৎকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্যোগে প্রায়োগিক গবেষণা প্রকল্প হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প শুরু হয়। প্রকল্পটির উত্তরোত্তর সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সমর্থনে ১৯৭৯ সালে টাঙ্গাইল জেলায় সম্প্রসারিত হয়। সাফল্যের সঙ্গে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রকল্প অবয়ব থেকে এটি পৃথক ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রচলিত ধারার বাইরে এসে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নোয়নে ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবর্তন করেন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি। শুরুটা জোবরা গ্রাম থেকে হলেও আজ এর বিস্তৃতি দেশজুড়ে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে।
দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের কী কী কার্যক্রম আছে?
নূর মোহাম্মদ: বর্তমানে ২ হাজার ৫৬৮টি শাখার মাধ্যমে দেশজুড়ে ৮১ হাজার ৬৭৮টি গ্রামে এক কোটির অধিক সদস্যের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করছে গ্রামীণ ব্যাংক। এখানে ঋণ বিতরণ কার্যক্রমের মধ্যে আছে সহজ ঋণ, গৃহনির্মাণ ঋণ, উচ্চশিক্ষা ঋণ, সংগ্রামী (ভিক্ষুক) সদস্য ঋণ, বিশেষ বিনিয়োগ ঋণ, পশু ঋণ, মৌসুমি ঋণ, সেতু ঋণ, নবীন উদ্যোক্তা ঋণ, পুঁজি সহায়ক ঋণ, বিশেষ ঋণ, শস্যঋণ। আমানতসমূহের মধ্যে আছে চলতি আমানত, সঞ্চয়ী আমানত, স্থায়ী আমানত, গ্রামীণ পেনশন স্কিম, আট বছরে দ্বিগুণ মেয়াদি আমানত, মাসিক মুনাফা, পরিবার কল্যাণ সঞ্চয়।
সদস্যদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান কী?
নূর মোহাম্মদ: গ্রামীণ ব্যাংকের দর্শন হচ্ছে ভূমিহীন, বিত্তহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করা। একজন সদস্যকে ঋণ দেওয়ার পরে তাঁকে ঋণ তদারকির মধ্যে রেখে ঋণের টাকা যেন যথোপযুক্ত কাজে ব্যবহার করে, তা নিশ্চিত করা হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন সদস্য সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ঋণ পেয়ে থাকেন। পরবর্তীকালে ঋণ পরিশোধ এবং কাজের পরিধির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের ঋণ গ্রহণ করতে পারেন। যদি কোনো সদস্য ঋণ পরিশোধে অপারগ হয়, সে ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতার সুবিধা অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ-সূচি পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
গ্রামীণ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ ক্ষুদ্রঋণ দিয়েছে?
নূর মোহাম্মদ: বিভিন্ন ঋণের ওপর ভিত্তি করে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদ শূন্য থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত। গ্রামীণ ব্যাংকের তথ্য বিবরণী অনুসারে, ২০২৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের মোট সদস্যসংখ্যা ১ কোটি ৬ লাখ ২৮ হাজার ২৮৫। এর মধ্যে নারী সদস্য ৯৭ শতাংশ। এ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৩ লাখ ১৪ হাজার ৬৬৫ দশমিক ৮৫ কোটি টাকা। গ্রামীণ ব্যাংকে জমাকৃত মোট আমানতের স্থিতি ২২ হাজার ৫০৫ দশমিক ২৫ কোটি টাকা। বর্তমানে আদায়যোগ্য ঋণ আছে ১৬ হাজার ৫৫৫ দশমিক ৫৭ কোটি টাকা। ঋণ আদায়ের হার ৯৬ দশমিক ৭১ শতাংশ।
ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের কী প্রভাব পড়ছে?
নূর মোহাম্মদ: গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে বর্তমানে দারিদ্র্য বিমোচনের হার ৬৮ শতাংশ। নারী কিংবা অক্ষরজ্ঞানহীন একজন দরিদ্র কৃষকও হয়ে উঠতে পারেন স্বাবলম্বী ও উন্নত জীবনের অধিকারী। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পর্যায়ের জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির আওতায় গ্রাম্য নারীরা গরু ও হাঁস-মুরগির খামার, মৎস্য খামার গড়ে তুলেছেন। অনেকেই কুটির শিল্প, হস্তশিল্প, মৃৎশিল্পের মাধ্যমে করেছেন ভাগ্যবদল। নার্সারি, মুদিদোকান কিংবা পোশাকের ব্যবসা ছাড়াও অনেকেই উদ্যোক্তা হয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
দারিদ্র্যসীমা থেকে বের হয়ে আসা সদস্য ও দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা সদস্যদের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক কীভাবে কাজ করে?
নূর মোহাম্মদ: দারিদ্র্যসীমা থেকে বের হয়ে সদস্যদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নবীন উদ্যোক্তা ঋণ, বিশেষ বিনিয়োগ ঋণ প্রদানসহ নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরির কার্যক্রম চলমান আছে। এ ছাড়া দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা ৩২ শতাংশ সদস্যের জন্য ঋণ কর্মসূচি অব্যাহত আছে। এভাবেই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে কাজ করছে গ্রামীণ ব্যাংক।