পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান থাকলে আন্দোলন এত বড় হতো না

কয়েক বছর ধরেই অর্থনীতি চাপে রয়েছে। ডলার-সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে ব্যাংক খাত। এমন এক পরিস্থিতিতে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরকার বদল হয়েছে। তাতে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় হামলার পাশাপাশি অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। আবার নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার মাস না পেরোতেই সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদীসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। এ নিয়ে কথা বলেছেন বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল।

শওকত আজিজ রাসেলফাইল ছবি

দেশের অর্থনৈতিক শক্তির অন্যতম উৎস হচ্ছে তৈরি পোশাক, বস্ত্র খাত ও প্রবাসী আয়। দেশের প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজনের জীবিকা কোনো না কোনোভাবে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু এ খাত নিয়ে বর্তমানে অন্তর্ঘাত চলছে। তৈরি পোশাক খাতে মূল অস্থিরতা হলেও বস্ত্র খাতেও বিচ্ছিন্নভাবে অস্থিরতা চলছে।

তৈরি পোশাকশিল্পে বর্তমানে যে অস্থিরতা হচ্ছে, তার অন্যতম কারণ কর্মসংস্থান। যদি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান থাকত, তাহলে এ আন্দোলন এত বড় হতো না; নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হতো। এ ছাড়া একটা গোষ্ঠী তো আছেই, যারা ইন্ধন দেয়। এ জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন।

শিল্প খাতে যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে, তার কিছুটা উন্নতি হলেও পুরোপুরি শঙ্কা কাটেনি। বিগত সরকারকে টেকাতে পুলিশ যেভাবে সক্রিয় ছিল, তার ১০ শতাংশও যদি এখন সক্রিয় হয়, তাহলে এ অস্থিরতা সমাধান হয়ে যাবে। গুটিকয় লোক ইন্ধন দিচ্ছে, যাদের চিহ্নিত করা সহজ কাজ। এদের আটকালে অস্থিরতা থাকবে না।

নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা ভালো পরিবর্তন আশা করছি। তবে এখন পর্যন্ত ভালোর কোনো মুখ দেখিনি। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বহু সমস্যা রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কার্যক্রম, বন্ড সুবিধা, চলতি মূলধন, ব্যাংকঋণসহ নানা ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে আমরা সুতা ও তুলা আমদানি করতে পারছি না; অন্যান্য কাঁচামাল আনতে পারছি না। ব্যাংক নিজেই এখন আর্থিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

আমি মনে করি, এই মুহূর্তে সরকার থেকে তিনটি জিনিস সর্বাগ্রে প্রয়োজন। প্রথমটি হচ্ছে শিল্প খাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রদান। দ্বিতীয়ত, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং সুবিধা দেওয়া। আর তৃতীয়ত, চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবস্থা করা।

দেশে বিদ্যুতের দাম কেন এত বেশি হবে। অতীতে দেখেছি, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বিভিন্ন কোম্পানিতে সরকার স্থানীয় মুদ্রায় অর্থায়ন করেছে। অথচ তাদের পেমেন্ট করতে হয় ডলারে। আমি মনে করি এভাবে একধরনের মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গত শাসনামলে বিশেষ ব্যক্তিদের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুযোগকে একটা উপহারের বিষয়ে পরিণত করা হয়েছিল। এখন আমরা টাকাও দিচ্ছি, বিদ্যুৎও পাচ্ছি না।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চাঁদাবাজি এ দেশ থেকে কখনোই পুরোপুরি যাবে না। তবে এটি যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে, সেটিই চাওয়া ব্যবসায়ীদের। পণ্যবাহী ট্রাক থেকে এখনো চাঁদাবাজি হচ্ছে; বরং আগের থেকে কিছুটা বেড়েছে। কারণ, পুরোনোদের সঙ্গে নতুন মুখ এসেছে।

সরকারের কাছে ব্যবসায়ীরা প্রণোদনা চাইলে তারা মনে করে যেন ভিক্ষা দিচ্ছে। অথচ এই প্রণোদনা থেকে যে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে, মূল্য সংযোজন হচ্ছে—এগুলো বিবেচনায় আনতে হবে। দেশে শিল্প ও বিনিয়োগ বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ দরকার। প্রতিযোগী দেশগুলো শিল্পের বিকাশের জন্য বিভিন্ন স্কিম নিয়ে আসছে। আমাদের দেশেও সরকারকে সেভাবে ভাবতে হবে এবং খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংকিং সহায়তা এখন আবশ্যক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জায়গায় ব্যাংকারদের মনোযোগ কম। ব্যাংকগুলোকে এখন বুঝতে হবে, তারা এখন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করবে, নাকি যে শিল্প বিদ্যমান আছে, সেটিকে আগে বাঁচাবে। নতুন কিছু করতে হলে এখন পাঁচ গুণ বেশি খরচ হবে। তাই আমি মনে করি, যেটা বিদ্যমান আছে, সেটিকে সহায়তা করা জরুরি।

লেখক– শওকত আজিজ রাসেল, সভাপতি, বিটিএমএ