আগামী বছর ইতিবাচক প্রভাব টের পাওয়া যাবে
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) যে মনে করছে অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে যাচ্ছে, এর সঙ্গে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। আমরা সবাই তা দেখতে পাচ্ছি। শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে আমরা দেখিয়েছি, উচ্চ প্রবৃদ্ধির যে দাবি করা হয়েছে, তা যথার্থ ছিল না। ফলে এখন একধরনের তথ্যগত সংশোধন হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সংস্কারমূলক কার্যক্রমের কারণেও অর্থনীতির গতি কমেছে।
অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ার পেছনে মূলত তিনটি কারণের কথা বলব। প্রথম, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রভিশন সংরক্ষণের হার বেড়ে গেছে; সেই সঙ্গে ঋণের সুদহার বেশি। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে। ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অর্থ হলো, বিনিয়োগযোগ্য অর্থ কমে যাওয়া। পরিণামে প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাবে।
দ্বিতীয়ত, দেশে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের চাহিদায় প্রভাব পড়ছে। পরিণামে বাজারে কেনাবেচা কমছে। কেনাবেচা কমে যাওয়ার কারণে বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের বাস্তবতা নেই। স্বাভাবিকভাবে প্রবৃদ্ধিতেও তার চাপ পড়বে।
তৃতীয়ত, জুলাই-আগস্ট মাসে দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল, তার জের অবশ্যই টানতে হবে, এর অন্যথা হওয়ার অবকাশ নেই। এখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফেরেনি। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্তিমিত হবে।
বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারি বিনিয়োগও কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস জুলাই-নভেম্বরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বাস্তবায়িত হয়েছে। এই সময়ে এডিপির মাত্র ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। বাস্তবায়ন হারের পাশাপাশি টাকার অঙ্কেও জুলাই-নভেম্বরে পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম খরচ হয়েছে। এডিপি বাস্তবায়ন কমে যাওয়ার প্রভাবও অর্থনীতিতে অনুভূত হবে। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে অর্থনীতির গতি অনেকটাই কমেছে বলে ধারণা করা যায়।
তবে এত নেতিবাচক বার্তার মধ্যে ইতিবাচক কিছু বিষয় আছে। যেমন মুদ্রার বিনিময় হার কয়েক মাস ধরে স্থিতিশীল। ডলারের বাজারে যে বিশৃঙ্খলা ছিল, তা অনেকটা দূর হয়েছে। বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থা বাজেট সহায়তা দিচ্ছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ও মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল হওয়ার পেছনে এই দুটি বিষয়ের প্রভাব আছে। প্রবাসী আয়ের প্রবাহও ভালো।
অর্থনীতিতে পুঞ্জীভূত সব সমস্যা মোকাবিলার পাশাপাশি চলমান সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকে ইতিবাচক ফল আসতে শুরু হবে বলে মনে করি।
আইএমএফ বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতা অনেকাংশে মেনে নিয়েছে। রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধির যে শর্ত তাদের ছিল, সেটা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সেই সঙ্গে নিয়মের পরিবর্তনের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণও অনেকাংশে বাড়বে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, আইএমএফ সেদিকে কড়া নজর রাখবে বলে মনে করি। ফলে নির্বাচনের পর নতুন যে সরকার আসবে, তারাও চাপে থাকবে বলে মনে করি।
সামগ্রিকভাবে আইএমএফের শর্তের সঙ্গে আমাদের দ্বিমত নেই। তারা যেসব শর্তের কথা বলেছে, সেগুলো আমাদেরও মনের কথা। ফলে সামগ্রিকভাবে সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত থাকুক, সেই আশা করি।
মোস্তাফিজুর রহমান: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো