সাক্ষাৎকার: পূবালী ব্যাংক এমডি

মৌলিক চাহিদা পূরণ করে, এমন খাতেই ঋণ দেয় পূবালী ব্যাংক

শুরুতে বেসরকারি খাত থেকে জাতীয়করণ। এরপর আবার বেসরকারি খাতের মালিকানায় যাত্রা শুরু করে পূবালী ব্যাংক। সমস্যায় পড়া ব্যাংক থেকে এখন এটি আধুনিক ও শক্তিশালী একটি ব্যাংক। মুনাফা ও কর্মী–সুবিধায় এখন দেশের শীর্ষ দুই ব্যাংকের একটি। পূবালী ব্যাংকের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এবং ব্যাংক খাতের সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব।

প্রথম আলো:

দেশের পুরোনো ব্যাংকগুলোর একটি পূবালী ব্যাংক। নানা সমস্যা মোকাবিলা করে এখন এটি আধুনিক ও স্মার্ট ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম। ব্যাংকটির এই রূপান্তর কীভাবে ঘটল?

মোহাম্মদ আলী: পূবালী ব্যাংক জন্মের পর থেকে নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ১৯৫৯ সালে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাত ধরে এই ব্যাংক যাত্রা শুরু করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এটি জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয়করণের আগে এটির নাম ছিল ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক। পরে নাম বদলে পূবালী ব্যাংক রাখা হয়। পরে ঋণের মান খারাপ হয়ে যাওয়ায় ১৯৮৪ সালে ব্যাংকটিকে আবার বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর ব্যাংক সংস্কারে মনোযোগ দেওয়া হয়। সংস্কারের অংশ হিসেবে শুরুতে মানবসম্পদ ও কর্মকর্তাদের সেবা দেওয়ার মানসিকতার উন্নয়ন ঘটানো হয়। পাশাপাশি শাখার অবকাঠামোর পরিবর্তন শুরু হয়।

এরপর নজর দেওয়া হয় সুশাসনে। ২০০৫ সালে পূবালী ব্যাংক সমস্যাযুক্ত ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসে। ফলে ২০০৭ সালে পর্যবেক্ষক তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ২০০৮ সালে ব্যাংকিং থেকে কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যারের (সিবিএস) মাধ্যমে ব্যাংকের নতুন রূপান্তর ঘটে। তখন আমি এই ব্যাংকে যোগদান করি। এরপর থেকে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে শুরু করে পূবালী ব্যাংক। একই সময়ে ভিসা, মাস্টারকার্ড, কিউ ক্যাশের মাধ্যমে কার্ড সেবাও শুরু হয়, নিজস্ব এটিএম, সিআরএম বসানো হয়। গ্রাহকের সুবিধার কথা চিন্তা করে নতুন নতুন সেবা চালু করা হয়েছে। আমাদের ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা পাইয়ের মাধ্যমে খুচরা ও করপোরেট গ্রাহকেরা ঋণ আবেদন, ঋণ পরিশোধ, ঋণপত্র খোলাসহ সব ধরনের সুবিধা পান। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত ডিজিটাল লেনদেনের যত উদ্যোগ নিয়েছে, তার সবগুলোর নেতৃত্ব দিয়েছে পূবালী ব্যাংক। আমাদের সব ডিজিটাল সেবা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়। ফলে প্রচুর গ্রাহকও পেয়েছি আমরা।

ভবিষ্যতে আমরা পূবালী ব্যাংককে বহুজাতিক ব্যাংকে রূপ দিতে পারি কি না, সে চেষ্টা করব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডিজিটাল ব্যাংকের যেসব সেবা চালু হচ্ছে, আমরাও তা চালু করতে চাই।

প্রথম আলো:

এ কারণেই কি পূবালী ব্যাংকের তহবিল খরচ কম?

মোহাম্মদ আলী: আমরা শাখা, উপশাখা ও বুথের মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে বেশি স্থানে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিয়েছি। বর্তমানে পূবালী ব্যাংক সবচেয়ে বেশি নেটওয়ার্ক–সমৃদ্ধ বেসরকারি ব্যাংক। দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকের আস্থা রয়েছে এই ব্যাংকের ওপর। এ কারণে খুচরা আমানত অনেক বেশি। পূবালী ব্যাংকের ৬৫ শতাংশ আমানত সাধারণ গ্রাহকের। এসব আমানতের সবই কম সুদে পাওয়া গেছে। এখন ডিজিটাল সেবার জোয়ার চলছে। সামনে ঋণও ডিজিটাল মাধ্যমে বিতরণ করা হবে। আমরা দ্রুত সেই পথে যাচ্ছি। শুরুতে সাশ্রয়ী গৃহঋণ ও ক্রেডিট কার্ড পাওয়া যাবে ডিজিটাল মাধ্যমে আবেদন করে। চলতি বছরই এ সেবা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

পূবালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় অনেক কম। এত পুরোনো ব্যাংক হওয়ার পরও কীভাবে খেলাপি ঋণ এত কমে রাখা সম্ভব হলো।

মোহাম্মদ আলী: আমাদের খেলাপি ঋণ এখন ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। যত দূর জানি, খেলাপি ঋণের এই হার দেশের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। এই ব্যাংকে কোনো বেনামি বা ব্রিফকেস প্রতিষ্ঠানের ঋণ নেই। কোনো ঋণ দেওয়ার আগে প্রথমে শাখা পর্যায় থেকে পরিদর্শন করা হয়, এরপর প্রধান কার্যালয় থেকে গ্রাহকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হয়। বড় ঋণের ক্ষেত্রে আমি নিজেও পরিদর্শনে যাই। এর পরও যদি সন্তোষজনক না মনে হয়, তখন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার মান, শিল্পের যন্ত্রপাতি ও আর্থিক বিবরণী যাচাই করা হয়। পাশাপাশি আইনজীবীর মতামত নেওয়া হয়। এত সব প্রক্রিয়ার কারণে আমাদের খেলাপি ঋণ কম। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণে খেলাপির হার ১ শতাংশের কম। আর করপোরেট ঋণে খেলাপি ৩ শতাংশের কিছুটা বেশি।

মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে, এমন খাতের বাইরে অন্যত্র ঋণ দেয় না পূবালী ব্যাংক। ব্যবসায় আমাদের যত ঋণ আছে, তার সবই খাদ্য ও খাদ্যসামগ্রী খাতে। এ ছাড়া বস্ত্র ও বস্ত্রসংশ্লিষ্ট খাতে আমাদের বড় বিনিয়োগ আছে। বাসস্থানের মধ্যে যারা সাশ্রয়ী আবাসন করে, আমরা তাদের অর্থায়ন করেছি। হাসপাতাল খাতেও আমাদের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। শিক্ষার মধ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেককে আমরা অর্থায়ন করেছি। এর ফলে আমরা খেলাপি ঋণ কমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি।

প্রথম আলো:

যেকোনো ব্যাংকের গ্রাহকসেবার মূলে থাকেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। পূবালী ব্যাংকে কাজের পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তেমন কোনো অসন্তোষও শোনা যায় না, কারণ কী।

মোহাম্মদ আলী: ২০১১ সালে আমি দুটি বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে ঠিক করি, পূবালী ব্যাংক একজন গ্রাহককে তার সারা জীবনের প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং সেবা দেবে। এটা করতে গিয়ে আমরা দেখলাম, ব্যাংকের কর্মীরা হঠাৎ ব্যাংক ছাড়েন না। পরিচালক ও শেয়ারধারীরাও এই ব্যাংক ছেড়ে যান না। যাঁরা এই ব্যাংকের সরবরাহকারী, তাঁরাও অনেক পুরোনো। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোও দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সঙ্গে রয়েছে। কর্মীদের উন্নয়নে আমরা দেশে ও বিদেশে যত প্রশিক্ষণ দিয়েছি, অন্য কোনো ব্যাংক তা দেয়নি। আমাদের কৌশল হলো, সৃজনশীলতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে যদি কর্মীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাহলে সেবার মান বাড়ে। একজন গ্রাহককে যেমন আমরা সারা জীবন ধরে রাখতে চেয়েছি, একইভাবে কর্মীকেও ধরে রাখতে চেয়েছি। এ জন্য দেড় দশক ধরে দুই-তিন বছর পরপর বেতনকাঠামো পুনর্গঠন করা হয়েছে। এবার অন্য কোনো ব্যাংক যখন বেতন বাড়াচ্ছে না, তখন আমরা ১৮ শতাংশ বেতন বাড়িয়েছি। এখন দেশীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুবিধা দিচ্ছে পূবালী ব্যাংক। ব্র্যাক ব্যাংকের পরে আমাদের মুনাফা সবচেয়ে বেশি। মুনাফার একটি অংশ কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করেছি। এবারও ছয়টি মূল বেতনের সমান মুনাফার ভাগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শেয়ারধারীদেরও ২৫ শতাংশ মুনাফা দেওয়া হয়েছে।

প্রথম আলো:

বড় অনেক শিল্পগোষ্ঠী খেলাপি হয়ে পড়ছে। তাতে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ব্যাংক খাতের সংকট মোকাবিলায় করণীয় কী?

মোহাম্মদ আলী: কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার আগে ঋণের গ্রাহক কারা, তাদের ভাবমূর্তি কেমন এসবও দেখা উচিত। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের মালিক যদি রাজনীতির সঙ্গে খুব বেশি যুক্ত থাকে, অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়, তাহলে সেই ঋণে ঝুঁকিও বেশি থাকে। আমাদের ব্যাংকের খারাপ অবস্থা ঠিক করতে ২১ বছর সময় লেগেছে। যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশের বেশি, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সেসব ব্যাংকের ১৫-২০ বছর সময় লাগবে। এখন অনেকের সম্পদ বিক্রি করে টাকা আদায় করতে চাইলেও ক্রেতা পাওয়া যাবে না। পুরো আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে একেক খেলাপি ঋণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চার-পাঁচ বছর সময় লাগবে।