বাণিজ্যমন্ত্রী যে লিপস্টিক তত্ত্বের কথা জানেন না
এদুয়ার্দো গালেয়ানো নামে উরুগুয়ের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক ছিলেন। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘সর্বোত্তম ভাষা হলো নীরবতা। অথচ আমরা এখন ভয়ানক শব্দস্ফীতির সময় বাস করি, যা মুদ্রাস্ফীতির চেয়েও অনেক খারাপ।’ কথাটা বাংলাদেশের কেউ লিখলে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যেত, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় এ দেশের মন্ত্রীদের কথাবার্তা শুনেই হয়তো কথাগুলো লেখা হয়েছে।
এই যেমন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, দেশে নিত্যপণ্যের দাম অনেকটা বাড়লেও তাঁর এলাকার (রংপুর) মানুষ কষ্টে নেই; বরং তাঁর এলাকার ‘নারীরা দিনে তিনবার লিপস্টিক লাগাচ্ছেন, চারবার স্যান্ডেল বদলাচ্ছেন’। অর্থাৎ বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে সুখে থাকার সংজ্ঞা হচ্ছে তিনবার লিপস্টিক লাগানো। এমন নয় যে সবাইকে অর্থনীতি জেনে কথা বলতে হবে, তবে কাণ্ডজ্ঞান আশা করাই যায়। তা ছাড়া লিপস্টিক তত্ত্ব নিয়ে দুই বছর ধরে লেখালেখি কম হচ্ছে না। সুতরাং চোখ–কান খোলা রাখাও দরকার।
লিপস্টিক তত্ত্ব
যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জুলিয়েট শোর ১৯৯৮ সালে ‘দ্য ওভারস্পেন্ট আমেরিকান’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি প্রথম লিপস্টিক তত্ত্ব সামনে নিয়ে আসেন। আর ২০০০ সালে আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দার সময় প্রসাধন সংস্থা এস্টি লডার ‘দ্য লিপস্টিক এফেক্ট’ শব্দটি ব্যবহার করে এ তত্ত্ব জনপ্রিয় করেছিল। আসলে জুলিয়েট শোর দেখিয়েছিলেন, মানুষের আয় যখন কমে যায়, তখন তারা বিলাসপণ্য কেনা বন্ধ বা কমিয়ে দেয়। এর পরিবর্তে মানুষ কম দামি বিলাসপণ্য কেনার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। মানুষ তখন দামি ফারের কোট বা দামি ব্যাগ কিনতে পারে না; যেতে পারে না দামি দোকানে, এ কারণে শখ পূরণ করতে কম দামি বিলাসপণ্য কেনে। এতেই বাড়ে লিপস্টিকের বিক্রি।
আবার অর্থনৈতিক মন্দার সময় লিপস্টিক বিক্রি বেড়ে যাওয়ার আরও একটি কারণ আছে। মানুষ তখন নিজের আর্থিক কষ্টের কথা ভুলে থাকতে নিজের প্রতি বেশি যত্নশীল হয়, নিজেকে পরিপাটি রাখার চেষ্টা করে। এ সময় লিপস্টিকের চাহিদা বাড়ে; কারণ সাজগোজ করার জন্য তুলনামূলক সস্তা পণ্য হচ্ছে লিপস্টিক। প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে নাইন–ইলেভেন বা টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল, তখন লিপস্টিক বিক্রি বেড়েছিল ১১ শতাংশ। প্রসাধন কোম্পানি এস্টি লডারের চেয়ারম্যান লিওনার্দ লডার একই প্রবণতা দেখেছিলেন ২০০৮ সালের মন্দার সময়। ফলে বেশ জোরেশোরেই প্রতিষ্ঠা পায় ‘দ্য লিপস্টিক এফেক্ট’ নামের এ তত্ত্ব। পরবর্তীকালে টেক্সাস ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটির দুই অধ্যাপক সারাহ হিল ও ক্রিস্টোফার রডেনহেফার এ নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে এ তত্ত্ব আরও জোরদার করেছিলেন। ১৯২৯ সালের বিশ্বমন্দার সময় একই ঘটনা ঘটেছিল—সেই হিসাবও অর্থনীতিবিদেরা বের করেছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি সৌন্দর্যচর্চায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।
মূল্যস্ফীতি ও বাংলাদেশ
গত অক্টোবর মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অর্থাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতির লাগাম কিছুতেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। প্রথম আলোতেই লেখা হয়েছে, তিন মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের ওপরে। এর অর্থ হচ্ছে, বেঁচে থাকার জন্য কেবল খাদ্য কিনতেই সীমিত আয়ের মানুষদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। সে কারণেই মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় নীরব ঘাতক। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান যেমনটা বলেছিলেন, ‘মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ছিনতাইকারীর মতো হিংস্র, সশস্ত্র ডাকাতের মতো ভয়ংকর আর খুনির মতোই প্রাণঘাতী।’
মূল্যস্ফীতি কমানো নিয়ে সরকারের মন্ত্রী ও অন্য নীতিনির্ধারকেরা দুই বছর ধরে যত কথা বলেছেন, তা লিখে রাখলে একটা মোটা বই হয়ে যাবে। আর তাঁরা যত আশ্বাস দিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি তত বেড়েছে। আশ্বাস শুনতে ভালো লাগে, মনের মধ্যে হয়তো ক্ষীণ আশাও জাগে; তবে এসব আশ্বাস যখন উপহাসের পর্যায়ে চলে যায়, সমস্যা তৈরি হয় তখনই—ফলে বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে প্যারিস, সুইজারল্যান্ড বা সিঙ্গাপুর হয়ে যাচ্ছে, মেয়েরা তিনবার লিপস্টিক লাগাচ্ছেন, চারবার স্যান্ডেল পাল্টাচ্ছেন। তবে অর্থনীতির তত্ত্ব মেনে এখন যদি বলা হয়, প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে সবচেয়ে খারাপ আছে আসলে বাণিজ্যমন্ত্রীর এলাকার মানুষ, তাহলে কি ভুল হবে? কেননা, তাঁর এলাকার মেয়েরা তিনবার লিপস্টিক লাগান।
আগাম সতর্কতা
২০০৮ সালের মন্দার সময় লিপস্টিকের চাহিদা যেমন বেড়েছিল, তেমনি এর উল্টো এক বিষয়ও দেখা গিয়েছিল। এক বছর আগে এ নিয়ে প্রথম আলোতেই লেখা হয়েছিল যে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক–ব্যবস্থা ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) তৎকালীন চেয়ারম্যান অ্যালান গ্রিনস্প্যান দেখেছিলেন, মন্দার সময় মানুষ অন্তর্বাস কেনা কমিয়ে দেয়। তখন কাপড় কেনা দায় হয়ে যায়, নতুন অন্তর্বাস কেনা মানুষের জন্য বাড়তি ঝামেলায় পরিণত হয়। অ্যালান গ্রিনস্প্যান বলেছিলেন, আমেরিকার পুরুষদের মধ্যে নতুন নতুন অন্তর্বাস কেনার ঝোঁক রয়েছে, নির্দিষ্ট কিছু ব্র্যান্ডের অন্তর্বাসের প্রতি রয়েছে বিশেষ দুর্বলতা। তবে সাম্প্রতিক সমীক্ষার তথ্য বলছে, বিগত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষদের মধ্যে অন্তর্বাস কেনার পরিমাণ অনেক কমে গেছে আর তা দেখেই মন্দার আশঙ্কা করছেন দেশটির অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। মন্দাকালীন অবস্থা বোঝার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষের অন্তর্বাস সূচক ব্যবহার করা হয়। ২০০৭ ও ২০০৯ সালে মন্দার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষের অন্তর্বাস বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে গিয়েছিল।
পোশাক খাতের ব্যবসায়ী মন্ত্রী পোশাক নিয়েও হয়তো কথা বলতে পারেন; অর্থাৎ আবার নতুন কী বলেন, তাই অন্তর্বাস তত্ত্বের কথা আগেই জেনে রাখা ভালো।