ইপিবির রপ্তানির হিসাব নিয়ে আপনারা অনেক দিন ধরের দ্বিমত প্রকাশ করে আসছেন। এই সন্দেহের পেছনের কী যুক্তি ছিল?
মোহাম্মদ হাতেম: ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা নিজেরা উৎপাদন ও রপ্তানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম নিজেদের কারখানায় তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ কম, ফলে রপ্তানিও কমে গেছে। আমাদের পাশের কারখানায়ও ক্রয়াদেশ ও রপ্তানি কম। আমাদের প্রতিষ্ঠানের মনোনীত ব্যাংকের শাখায় প্রতি মাসে ৪-৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হলেও ওই সময় তা কমে ৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। অথচ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বলছিল, রপ্তানি বেড়েছে। ওই বছরের নভেম্বরে ৫০৯ কোটি ডলারের রপ্তানির তথ্য দেয় ইপিবি, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ রপ্তানি। তখন আমি বলেছিলাম, এই রপ্তানি আমরা করি নাই। কারা করেছে আমরা জানি না। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর ইউডির হিসাবের সঙ্গেও এই হিসাব মেলে না। তারপরও কয়েক মাস ধারাবাহিকভাবে ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলারের বেশি রপ্তানির তথ্য দিয়ে যাচ্ছিল ইপিবি। সে কারণে আমরা ইপিবির রপ্তানির তথ্য নিয়ে দেড় থেকে দুই বছর ধরেই দ্বিমত প্রকাশ করে আসছি।
রপ্তানির তথ্যের গরমিল কেন হলো? এ বিষয়ে আপনারা কি কিছু জানতে পেরেছেন?
মোহাম্মদ হাতেম: ইপিবির রপ্তানির হিসাবের তথ্য নিয়ে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির উপস্থিতিতে একটি বৈঠকে আপত্তি জানিয়েছিলাম। বৈঠকে ইপিবি ও এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন। সেখানে ইপিবির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, তাঁরা মূলত এনবিআরের সরবরাহ করা তথ্য ব্যবহার করেন। অন্যদিকে এনবিআরের কর্মকর্তা বলেন, এসআই কোডা সফটওয়্যার থেকেই এই তথ্য–উপাত্ত দেওয়া হয়। একই রপ্তানির তথ্য একাধিকবার গণনার কারণে হিসাবে ত্রুটি থাকতে পারে। তবে রপ্তানির গরমিলের কারণ ইপিবি ও এনবিআরই ভালো বলতে পারবে। এটির সঙ্গে বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ কোনোভাবে যুক্ত নয়।
রপ্তানির হিসাব বাড়িয়ে দেখানোর কারণে তৈরি পোশাকশিল্পে কি কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে?
মোহাম্মদ হাতেম: দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে আমরা অনেক দিন ধরেই চ্যালেঞ্জের মধ্য রয়েছি। রপ্তানির গোলমেলে হিসাবের কারণে সামনে খারাপ সময় দেখছি আমরা। রপ্তানির ভুল তথ্যের জন্য আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমেছে। কারণ, ইপিবির বাড়িয়ে দেখানো রপ্তানির তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সরকার নীতি গ্রহণ করেছে। বর্তমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দেশের ডলার–সংকট কাটাতে সরকারের উচিত ছিল তৈরি পোশাকশিল্পকে আরও সহায়তা দেওয়া। তবে সেটি না করে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার কমিয়ে দেওয়া, ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র করতে ব্যাংকের গড়িমসি, ঋণের কিস্তি ছয় মাসের পরিবর্তে তিন মাসের মধ্যে দেওয়ার বাধ্যবাধ্যকতা এবং সর্বশেষ প্রণোদনা অর্ধেকের নিচে নামিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। একদিকে রপ্তানি কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। তারপরও অধিকাংশ সময় কারখানায় গ্যাস পাওয়া যায় না। তাতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এটিও রপ্তানি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এতে ক্রেতাদের আস্থাও কমেছে। অনেকেই বলার চেষ্টা করেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সুফল আমরা পাচ্ছি। যদিও তাঁরা এটা বলেন না, ডলারের দাম যতটুকু বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ বেড়েছে। পোশাক রপ্তানিকারকেরা তো ১৫-২০ শতাংশের বেশি ডলার নগদায়ন করতে পারেন না। কারণ, বড় অংশ কাঁচামাল ও সরঞ্জামের পেছনে চলে যায়। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দর–কষাকষিতে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। প্রতি মাসেই লোকসান গুনছে ৮০ শতাংশের বেশি প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃত রপ্তানির যে হিসাব দিচ্ছে, সেটি পুরোপুরি সঠিক কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদেরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ক্ষেত্রে আপনাদের প্রত্যাশা কী?
মোহাম্মদ হাতেম: কাদের ভুলের কারণে রপ্তানির হিসাব ওলট–পালট হয়ে গেল, সেটি খুঁজে বের করা দরকার। এই প্রক্রিয়ায় রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদেরও যুক্ত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া প্রকৃত রপ্তানি হিসাব যেটি করা হয়েছে, সেটি সঠিক কি না, তা–ও নিশ্চিত হতে হবে। তবে আমাদের কাছে প্রকৃত রপ্তানির তথ্য প্রাথমিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে অন্যান্য যেসব সূচক এ রপ্তানি তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে, সেগুলোর পরিবর্তনও দ্রুত করা উচিত।