সিটি ব্যাংক নিজেই একসময় সমস্যাযুক্ত ব্যাংক ছিল। এবার অন্য একটি সমস্যায় পড়া ব্যাংককে উদ্ধারের দায়িত্ব পেয়েছিল? সেই উদ্যোগের কী অবস্থা।
মাসরুর আরেফিন: আমরা কয়েকজন বিদেশি ব্যাংক থেকে যখন ২০০৭ সালে সিটি ব্যাংকে যোগ দিই, তখন ব্যাংকটি সমস্যাযুক্ত একটি ব্যাংক ছিল। মানুষ এ ব্যাংকে আমানত রাখত না। ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল বছরে মাত্র ২৪ কোটি টাকা। মন্দঋণের অনুপাত ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। আর মূলধন পর্যাপ্ততা ছিল নির্ধারিত সীমার নিচে। সেই ব্যাংকই এখন অন্য একটা সমস্যাযুক্ত ব্যাংককে অধিগ্রহণ করে ঠিক পথে আনুক, এমন একটা কর্তব্য-সম্পর্কিত উৎসাহ আমরা সরকারের তরফ থেকে পেয়েছিলাম। বিষয়টি ২০০৭ সালের সেই সিটি ব্যাংকের নিরিখে আমাদের জন্য অবশ্যই গর্বের। ব্র্যাক ব্যাংক ও সিটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া ‘শীর্ষ টেকসই ব্যাংক’ হিসেবে পরপর তিন বছর স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতির অর্ধেক নম্বর আসে মূলধন পর্যাপ্ততা, তারল্য পরিস্থিতি, মন্দঋণ অনুপাত, আয়-ব্যয় অনুপাত এসব সূচক থেকে।
২০০৭ সালের সমস্যাসংকুল ব্যাংক থেকে বেরিয়ে কীভাবে ভালো ব্যাংকে পরিণত হলো সিটি ব্যাংক?
মাসরুর আরেফিন: ব্যাংকের ভালো করার মূল বিষয় পাঁচটি। হাতের পাঁচ আঙুলের মতো। প্রথম কথা, সুশাসন। তার জন্য দরকার সৎ মানুষ দিয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠন, যারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে আজেবাজে ঋণ ব্যাংককে গছিয়ে দেবেন না। ২০০৭ সাল থেকে আমি এই ব্যাংকে আছি। আর বর্তমান চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সারও বড় একটা সময় এ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে আছেন। তাঁকে ও তাঁর পরিচালনা পর্ষদকে আমি আজ পর্যন্ত একবারও দেখিনি কোনো ঋণ দেওয়া নিয়ে বা কোনো ক্রয় নিয়ে আমাদের চাপ দিতে। ওদিকে বিশ্বব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এ ব্যাংকের পর্ষদে বসে সুশাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নানা ভূমিকা রাখছে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান বাস্তবতায় একটি ব্যাংক শুধু ব্যাংক হয়ে থাকলেই চলবে না, ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে হবে। ব্র্যান্ড হয়ে উঠলে ব্যাংকের জনপ্রিয়তা বাড়ে। তাতে আমানতের ব্যয় কমে যায়। যেটাকে আমরা ‘কস্ট অব ডিপোজিট’ বলি। বর্তমানে আমাদের কস্ট অব ডিপোজিট ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আমাদের তারল্য সুরক্ষা অনুপাত বর্তমানে ১০০–এর জায়গায় ১৭৪ শতাংশ। ভালো ব্যাংক হতে গেলে তৃতীয়ত দরকার ঋণের মান। এটি ভালো থাকলে ব্যাংক লাভজনক থাকবে। তাতে মূলধন বাড়তে থাকবে। আমাদের মন্দঋণ মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ওই মন্দঋণের বিপরীতে আমাদের নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং আছে ১১৫ শতাংশ অর্থ। চতুর্থত বিষয় ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের অনুপাত কমিয়ে আনা। গত বছর আমাদের এই অনুপাত ছিল ৫১ দশমিক ২ শতাংশ। ভালো ব্যাংক হতে গেলে সর্বশেষ যে বিষয়টি দরকার, সেটি মূলধন পর্যাপ্ততা। শুধু ভালো মুনাফা করলেই হবে না। মূলধন কম খরচ হয়, এমন খাতে ঋণ দিয়ে ও লভ্যাংশ বিতরণ যৌক্তিক পর্যায়ে রেখে সেটি করতে হবে। আমরা ন্যূনতম ১২ দশমিক ৫ শতাংশের জায়গায় ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ মূলধন পর্যাপ্ততায় আছি। সেটিকে আমরা ১৭ শতাংশে নিতে চাই।
২০১৯ সালে আপনি এমডি হওয়ার আগে সিটি ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ২২২ কোটি টাকা। গত বছর সেটি বেড়ে হয়েছে ৬৩৮ কোটি টাকা। পাঁচ বছরে মুনাফা প্রায় তিন গুণ বাড়ল। কীভাবে সেটি সম্ভব হলো?
মাসরুর আরেফিন: অনেক কারণের পাশাপাশি ব্যাংকে ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা এই মুনাফা অর্জনের পেছনে অন্যতম কারণ। এর ফলে আমাদের কর্মীদের উদ্যম বেড়েছে। আমরা নালিশ ও অভিযোগের ফোরাম চালু করেছি। অন্যায়, হয়রানি, পারফরম্যান্স রেটিং ও পদোন্নতিতে পক্ষপাতিত্ব, এসবের বিরুদ্ধে ‘মুখ খুলুন’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করেছি। আর ব্যাংকে মূল্যবোধকে সবচেয়ে উঁচুতে রেখেছি। এ ছাড়া ডিজিটাল অভিমুখে যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের সিটিটাচ অ্যাপ দেশের ব্যাংকিং জগতের সেরা অ্যাপ। এতে লেনদেনের পরিমাণ চলতি বছর ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে। আবার বিকাশের সঙ্গে ডিজিটাল ক্ষুদ্রঋণ সেবা ভালোই এগোচ্ছে। এখন আমরা নিজেদের রিটেইল ও কার্ড গ্রাহক এবং মার্চেন্টদেরকেই ডিজিটাল ঋণ দিতে চাচ্ছি।
আপনাদের আর্থিক সূচক এত ভালো হওয়ার পরও বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা তালিকায় হলুদ শ্রেণিতে রয়েছে সিটি ব্যাংক। এর কারণ কী।
মাসরুর আরেফিন: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করা এই লাল–হলুদ তালিকা যে ভুল ছিল, সেটা তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করেই জানিয়ে দিয়েছেন। সেখানে তাঁরা বলেছেন, এটা ছিল একটা ধারণাভিত্তিক মডেলিং, বাস্তবভিত্তিক নয়। তাঁরা আরও বলেছেন, এটা ব্যাংকের স্বাস্থ্য দেখার জন্য কোনো সঠিক পদ্ধতি নয়। অতএব, এ বিষয় নিয়ে কথা বলার আমি আর কিছু দেখি না।
আপনারা বৈদেশিক মুদ্রা হিসাব (আরএফসিডি) ও অফশোর ব্যাংকিংয়ে বেশ মনোযোগ দিচ্ছেন। এর কারণ কী?
মাসরুর আরেফিন: এ দুই ব্যবস্থাই আমাদের ব্যাংক খাত ও অর্থনীতির জন্য যুগান্তকারী ঘটনা। এর ফলে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি ডলারের জোগানে আরও নতুন দুটি খাত যুক্ত হয়েছে। একটি আরএফসিডি বা নগদ ডলারের সরবরাহ। অন্যটি অফশোর ব্যাংকিংয়ের স্থায়ী আমানত। দুটিই আমদানি ব্যয় মেটাতে কাজে লাগছে। আরএফসিডির ডলার নগদ ডলার হলেও আমরা নানা বৈধ পদ্ধতির মাধ্যমে সেটা দিয়েও আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছি। আবার এই দুই ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রাপ্ত ডলার আন্তব্যাংকে বিক্রি করা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ডলার-টাকা ‘সোয়াপ’ বা বিনিময় করে আমরা টাকার সরবরাহও বাড়াতে পারছি। দেশের নগদ ডলারের স্থিতি সম্প্রতি ৮০ লাখ ডলারে নেমে এসেছিল। আমাদের আরএফসিডির কারণে কিছুদিন আগে তা ৫ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এই ৫ কোটি ডলারের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ ডলারই ছিল সিটি ব্যাংকের। বর্তমানে আমাদের ৫ হাজার ৫৮২টি আরএফসিডি হিসাবে ১ কোটি ৭০ লাখ ডলার জমা হয়েছে। এ ছাড়া অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় সাড়ে ৮ শতাংশে বিদেশি ঋণ নিয়ে আমদানি দায় শোধের চেয়ে দেশের মানুষকে সাড়ে ৭ শতাংশ সুদ দিয়ে স্থায়ী আমানত নেওয়াটা অনেক ভালো। বর্তমানে অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় বিভিন্ন মেয়াদি স্থায়ী আমানতের সুদহার ৬ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। আর এই আয় সম্পূর্ণ করমুক্ত।
অফশোর ব্যাংকিংয়ের আমানতে কেমন সাড়া মিলছে। আপনাদের লক্ষ্য কী?
মাসরুর আরেফিন: অফশোর ব্যাংকিংয়ের আওতায় এখন আমাদের আমানতের স্থিতি ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আরেকটি হিসাবে ৫০ লাখ ডলার আসছে। বাংলাদেশে বাস করছেন, এমন যে কেউ এখন আমাদের ১৭৫টি শাখা-উপশাখায় গিয়ে অফশোর আমানতের জন্য ডলারের চলতি হিসাব খুলতে পারছেন। তারপর বিদেশে তাঁর আত্মীয়স্বজন বন্ধু বা ব্যবসায়িক অংশীদারকে বলছেন ওই হিসাবে ডলার পাঠাতে। আমরা এটাকে বলছি ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক হিসাব। এটিও অফশোর আমানত হিসাব, কিন্তু দেশে থাকা মানুষদের জন্য। আমাদের এ ধরনের হিসাবে জমা হয়েছে ২৯ লাখ ডলার। মানুষ ভালোমতো জানলে আমাদের ব্যাংকগুলোর অফশোর আমানত হিসাবে ৫০ বিলিয়ন বা ৫ হাজার কোটি ডলার আসবে। ১৫ বিলিয়ন ডলার অর্থনীতির দেশ মরিশাসে যদি অফশোর আমানত ৮০০ বিলিয়ন ডলার থাকতে পারে, তাহলে ৪৭০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির বাংলাদেশে কেন ৫০ বিলিয়ন ডলার অফশোর আমানত থাকবে না? অফশোর আমানত একদিন এ দেশে ডলার আনার দ্বিতীয় বড় খাত হবে।
টাকা ও ডলারের বিনিময় হার কিছুটা বাজারভিত্তিক হলো। এতে কি সংকট কাটবে? অর্থনীতিতে এর প্রভাব কী হতে পারে?
মাসরুর আরেফিন: টাকা ও ডলারের বাজারভিত্তিক হার দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। তবে বলে রাখা ভালো, ডলারের দর এখনো পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের মধ্যবর্তী দর ঠিক করেছে ১১৭ টাকা। এই দরকে মধ্যবর্তী দর বললেও এর নিচে বা ওপরে কোনো সীমা এখনো ঠিক করা হয়নি। ডলারের দাম মোটামুটি বাজারভিত্তিক হওয়ার কারণে প্রবাসী আয় বাড়বে। রপ্তানিও অন্য দেশের তুলনায় প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় থাকবে। বিদেশি বিনিয়োগ বেশি আসবে। সব মিলিয়ে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়বে। আমাদের অর্থনীতি আমদানি ও রপ্তানিনির্ভর। তাই আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে টাকার অবমূল্যায়ন ব্যষ্টিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব আনলেও সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এর ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে কি?
মাসরুর আরেফিন: হ্যাঁ, মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়তে পারে। কারণ, আমদানি এ দেশে একটা বড় বিষয়। কিন্তু সত্যি বলতে ব্যাংকগুলো ডলারপ্রতি ১১৬-১১৭ টাকাতেই আমদানি ব্যয় মেটাত, যদিও বলা ছিল দর ১১০ টাকা। তার মানে আমদানি ব্যয় বাস্তবে বাড়বে শুধু সরকারি আমদানিতে, যেগুলো ১১০ টাকা ডলার দরে হতো, যেমন জ্বালানি। আর মূল্যস্ফীতি আগে থেকেই বেশি ছিল। এখন দরকার অর্থনীতির গতিশীলতা বাড়ানো, যাতে করে বেতন বা মজুরি বাড়ে। তাহলে মূল্যস্ফীতির আঁচ গায়ে লাগবে না। মূল্যস্ফীতির ভয়ে ঘরে বসে থেকে লাভ নেই। অর্থনীতিতে প্রধান বিষয় হলো মানুষ তার আয় দিয়ে জীবনমান ধরে রাখতে পারছে কি না, সেটা দেখা। যদি সেটি পারে তাহলে দেখার বিষয়, কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে তা করতে পারছে। জাপানে এক কেজি আলুর দাম বাংলাদেশি টাকায় ৪৫০ টাকা। কিন্তু জাপানের জনগণের মাথাপিছু আয় ৩৪ হাজার ১৭ ডলার। আর বাংলাদেশে এক কেজি আলু মাত্র ৪০ টাকা, কিন্তু মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৮৮ ডলার। কে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে বাজার করতে পারছে? একজন জাপানি লোক আমার চেয়ে ১৩ গুণ বেশি আয় করে বলে, ওই আলুর দাম তার কাছে সহনীয়। কাজেই লেনদেন ভারসাম্যের উন্নতি ঘটাতে হবে, যাতে করে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়ে। দেশি অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও বিদেশি বিনিয়োগ দুটিই বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মানুষের আয় বাড়াতে হবে। তাহলে মূল্যস্ফীতি কোনো ব্যাপার হবে না।