ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকার গতিপ্রকৃতি, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু আছে কি
২৩ মে প্রথম আলোতে জানুয়ারি-মার্চ ২০২৪ সময়ে মানুষের হাতে নগদ টাকা বৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০২৪ সময়ে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬২১ কোটি টাকা।
এই বৃদ্ধির পেছনে তিনটি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমত, মার্চ ২০২৪ রোজার মাস হওয়ায় নগদ অর্থের চাহিদা বেড়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকের প্রতি মানুষের আস্থায় চিড় ধরা। তৃতীয়ত, সার ও বিদ্যুতের পাওনা বাবদ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংককে সরকার প্রদত্ত বন্ড বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রেখে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর টাকা ধার নেওয়া। আরেকটি সম্ভাব্য কারণ প্রতিবেদক উল্লেখ না করলেও সম্প্রতি একটি গবেষণা সংস্থার ব্যাংক–সংক্রান্ত সেমিনারে বিষয়টির অবতারণা করা হয়েছে। সেটা হলো, মূল্যস্ফীতির কারণে প্রকৃত সুদহার কমে যাওয়া।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ উল্টো বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সরকার কর্তৃক সার ও বিদ্যুতের পাওনা বাবদ বিভিন্ন ব্যাংককে দেওয়া বন্ড–সুবিধা দায়ী। তবে রোজার ঈদ সামনে রেখে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে রিজার্ভ মানি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রতিবেদনে আসেনি। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছে; এবং সাধারণভাবে অনেকে ব্যাংক ব্যবস্থা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি কি প্রকৃত অর্থেই আতঙ্কিত হওয়ার মতো? এই লেখায় তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
সারণি-১–এ গত ১০ বছর (মার্চ মাসে) রিজার্ভ মানি বা ছাপানো টাকার পরিমাণ ও ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণের তথ্য দেওয়া হয়েছে। যেহেতু বিভিন্ন কারণে মুদ্রার মাসওয়ারি সরবরাহ ও চাহিদা কিছুটা ওঠানামা করতে পারে, সেহেতু রিজার্ভ মানির সরবরাহ এবং নগদ অর্থের চাহিদার প্রবণতা তুলে ধরতে মাসিক বৃদ্ধির হারের পরিবর্তে বার্ষিক বৃদ্ধির হারের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। সারণি-১–এ দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, গত ১০ বছরের মধ্যে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে রিজার্ভ মানির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল সর্বনিম্ন।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক রিজার্ভ মানির বৃদ্ধির হার মুদ্রানীতিতে শূন্য শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল, যদিও প্রকৃত অর্থে তা ঋণাত্মক কোটায় ছিল—মাইনাস ২ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করায় রিজার্ভ মানির ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেষ্টা সত্ত্বেও মুদ্রা সরবরাহ সীমিত করা যাচ্ছে না, এ অভিযোগ সঠিক প্রতীয়মান হয় না।
এ ছাড়া সরকার প্রদত্ত বন্ড জমা রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ নেওয়া মুদ্রা ব্যবস্থাপনার নিয়মিত রীতি। তবে সব সরকারি বন্ড সব সময় ঋণ নেওয়ার প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় না। এটি নির্ভর করে বন্ডের নির্ধারিত সুদহার এবং আর্থিক খাতের তারল্য পরিস্থিতির ওপর। সুতরাং সরকার কর্তৃক সার ও বিদ্যুতের পাওনা বাবদ বিভিন্ন ব্যাংককে দেওয়া বন্ড–সুবিধা দেওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা সফল হয়নি, এটি ঢালাওভাবে বলার সুযোগ নেই।
সারণি-১–এ দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত ১০ বছরের মধ্যে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকার প্রবৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে কম। সুতরাং বোঝা যায়, মার্চ ২০২৪–এ ব্যাংকের বাইরে যে ৩ হাজার ৬২১ কোটি টাকা নগদ বৃদ্ধি হয়েছিল, তা মাসভিত্তিক তারতম্যের কারণে হয়েছে। রেখাচিত্র-১ দেখে বোঝা যায়, এই বৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদি ট্রেন্ড লাইনের খুব একটা বাইরে নয়; এবং সে জন্য এটি বড় ধরনের ব্যতিক্রম মনে করে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।
সারণি-১–এ ব্যাংক আমানতের তথ্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, সম্প্রতি আমানত বৃদ্ধির হার আগের বছরগুলোর তুলনায় খুব একটা কম নয়। সুতরাং ব্যাংকের ওপর আস্থায় চিড় ধরার কারণে কিংবা প্রকৃত সুদহার কমে যাওয়ায় মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে এবং সেই টাকা আর ব্যাংকে ফেরত আসছে না, এ আশঙ্কা খুব বাস্তবভিত্তিক প্রতীয়মান হয় না। এটা সত্যি, ইসলামি ব্যাংকিং খাতের কিছু ব্যাংকের বিষয়ে আস্থায় চিড় ধরায় এবং ব্যাংক একীভূতকরণ–সংক্রান্ত ঘোষণার পর কোনো কোনো ব্যাংক থেকে আমানতকারীরা বড় অঙ্কের আমানত তুলে নেন। কিন্তু সেই টাকা অন্য ব্যাংকে জমা না দিয়ে তার বড় অংশ তাঁরা হাতে রেখে দিয়েছেন বলে যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, তা উল্লেখিত তথ্যের ভিত্তিতে অনেকাংশে অমূলক প্রতীয়মান হয়।