বিশেষ সাক্ষাৎকার
ই–কমার্স মানে এমন নয় যে অর্ধেক দামে আইফোন পাবেন বা প্রতারণা করবেন
বিয়ার্কে মিকেলসেন বহুজাতিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস দারাজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ডেনমার্কের নাগরিক বিয়ার্কে মিকেলসেন একসময় বিনিয়োগ ব্যাংকার ছিলেন। নতুন কিছু করবেন বলে দারাজ প্রতিষ্ঠা করেন। গতকাল সোমবার প্রথম আলোর কারওয়ান বাজারের কার্যালয়ে এসেছিলেন। এ সময় প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শওকত হোসেন ও আব্দুল্লাহ আল হোসাইন।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বাংলাদেশ বেছে নেওয়ার কারণ কী?
বিয়ার্কে মিকেলসেন: দারাজের সবচেয়ে বড় বাজারগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ। সম্ভাবনাময় বাজারগুলোর একটিও বাংলাদেশ। ব্যবসায়িক সফলতার জন্য যে স্থিতিশীলতা দরকার, বাংলাদেশ সরকার সে বিশাল কাজটাই করে রেখেছে। শেষ আট বছর ধরে আমরা বাংলাদেশে আছি। এখন আমরা দেখছি, এখানকার সবকিছু বেশ গোছালো। সঠিক রাজনৈতিক সমর্থন আছে, সঠিক অর্থনৈতিক গতি আছে এবং ডিজিটালাইজেশনের গতি আছে, যা করোনাকালে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে ই-কমার্স খাত এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বাংলাদেশের ই-কমার্স বাজার কতটা বড়?
বিয়ার্কে মিকেলসেন: এখানকার ই-কমার্স বাজার ১০০ কোটি ডলারের, যার বড় একটা অংশই আমাদের দখলে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: কতটুকু?
বিয়ার্কে মিকেলসেন: সেটা বলা যাবে না। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, ই–কমার্স বাজারের আয়তন খুচরা বাজারের দেড় থেকে দুই শতাংশ। আমি মনে করি, আগামী পাঁচ বছরে তা বেড়ে দাঁড়াবে ২০ শতাংশে। কাজেই এটা এখনো বেশ ছোট। কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনি কোথায় বৃদ্ধির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি দেখেন? আমি বলি, সবখানে। আমরা এমন একটা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে মানুষ এখনো ই-কমার্স সেবায় অভ্যস্ত হচ্ছে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনাদের পরিকল্পনা কী?
বিয়ার্কে মিকেলসেন: প্রথমত, মূল মার্কেটপ্লেস প্রসারিত করা। এর অর্থ হচ্ছে প্ল্যাটফর্মে বেশি ক্রেতা, বেশি বিক্রেতাকে আকৃষ্ট করা। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী শত মিলিয়ন ক্রেতার কাছে পৌঁছানো। আমি মনে করি, এর অর্ধেকই বাংলাদেশ থেকে আসা উচিত। আমরা আমাদের বিক্রেতা গোষ্ঠী, ক্রেতা গোষ্ঠীর বিস্তৃতি অব্যাহত রাখব। সেবা ও পণ্য আমাদের ক্রেতা ও বিক্রেতার কাছে পৌঁছানো আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আমরা অন্য কাজও করে যাব। তবে এ জন্য বিশ্বাস বা আস্থা, পণ্যের গুণগত মান, সেবার মান, ক্রেতার জন্য সেবা—এসব বিষয়ের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে প্রথমে। মৌলিক এসব চাহিদার সবকিছু শতভাগ নিখুঁত হতে হবে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: ক্রেতাদের আস্থা বাড়াতে কী করছেন?
বিয়ার্কে মিকেলসেন: আমাদের এখন অগ্রাধিকার হচ্ছে লজিস্টিকস, যা ব্যবসায়িক মডেলকে লাভবান করা। এই মুহূর্তে আমরা লাভের মধ্যে নেই। আমরা অবশ্যই মুনাফা চাই। এর জন্য আমাদের বেশি পরিমাণে লজিস্টিক সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। এর অর্থ হচ্ছে পরিচালনায়, অবকাঠামো এবং নেটওয়ার্ক পরিচালনায় আমাদের বেশি বিনিয়োগ দরকার, যাতে সেবা দ্রুততম সময়ে দক্ষতার সঙ্গে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানো যায়। আর তৃতীয় কৌশল হচ্ছে অর্থ পরিশোধ। আমরা ভাগ্যবান যে বাংলাদেশে অর্থ পরিশোধের ভালো একটা অবকাঠামো পেয়েছি, ব্যাংকের মাধ্যমে, বিকাশ ও অন্যান্য ওয়ালেটের মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের ব্যবসার অর্ধেকই এখনো তরল টাকায়। তরল টাকায় লেনদেন খুবই ব্যয়বহুল। কাজেই শেষ পর্যন্ত আমাদের অর্থ পরিশোধের পথটা আরও স্থিতিশীল করতে চাই। এটা আমাদের ক্রেতাদের জন্য ভালো হবে, তাঁদের তরল অর্থ নিয়ে কিছু করতে হবে না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশে আপনাদের অভিজ্ঞতা কেমন?
বিয়ার্কে মিকেলসেন: আমার মনে হয়, বিভিন্ন দিক থেকে চিন্তা করলে বাজারগুলো একই ধরনের। কিন্তু বাংলাদেশে আমি ব্যতিক্রম শিল্পোদ্যোগ দেখতে পাই। এটা একটা বিরাট সুযোগ, বিশেষ করে বিক্রেতাদের জন্য। সত্যিকার অর্থেই বেশির ভাগ লোক মনে করে, দারাজ একটি কাস্টমার ফেসিং অ্যাপলিকেশন। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ হচ্ছে আমাদের সেলার অ্যাপ। এখানে বিক্রেতারা ফোন থেকেই তাঁদের পুরো ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তাঁদের সঠিক জিনিসটি দেওয়ার মাধ্যমে আমরা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগসমূহ (এসএমই) শক্তিশালী করতে পারি। সারা দেশে ব্যবসার সৃষ্টি করতে পারি। এই জায়গাটাতে বাংলাদেশ অনন্য।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আমরা জানি, বাংলাদেশ কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিছু ই-কমার্স শিল্প, কোম্পানি মন্দ ব্যবসা করছে, মন্দ দৃষ্টান্ত তৈরি করছে। আপনার অভিজ্ঞতা কী?
বিয়ার্কে মিকেলসেন: প্রথমত, যা ঘটেছে, তা ই-কমার্স শিল্পে একটা প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু আমি এটাকে একটা সুযোগ হিসেবেও দেখি। এমন একটি ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে প্রত্যেকেই ই–কমার্স বিষয়টি বুঝতে পারেন। ই–কমার্সের অর্থ এমন না যে আপনি অর্ধেক দামে একটা আইফোন পেয়ে যাবেন, অথবা আপনি প্রতারণা করবেন। ই-কমার্স বলতে সেবা বোঝায়, সেটাই হওয়া উচিত। মানুষকে সহায়তা করাই এর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর এর মাধ্যমে ক্রেতা ও বিক্রেতা একে অপরের সঙ্গে পণ্য লেনদেন করতে পারেন। কাজেই আমি ই–কমার্সের ব্র্যান্ডিংয়ের সুযোগ দেখি। আমরা মনে করি, নীতিমালা থাকা ভালো। নীতিমালা নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, এটি বেসরকারি খাতের সহযোগে হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে আমাদের সঠিক সময়ে সঠিক আলোচনাই হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত বেসরকারি খাত এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, ততক্ষণ পর্যন্ত নীতিমালা করা ভালো বিষয়। কিন্তু নীতিমালা প্রণয়নকারীদের মনে রাখতে হবে যে ই–কমার্স খাত এখনো বেশ ক্ষুদ্র, অর্থনীতিতে এর প্রভাব আছে, ডিজিটাল অর্থনীতির একটি অংশ এবং এটা বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে সহায়তা করতে পারে। আমাদের এমন নীতিমালা তৈরি করতে হবে, যা শিল্পের সমৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আমরা জানি, আলিবাবা দারাজকে কেনে ২০১৮ সালে। ২০১৮ সালের আগে ও পরে আপনার অভিজ্ঞতা কী?
বিয়ার্কে মিকেলসেন: প্রথমেই আমি বলব, আলিবাবা দারুণ একটা পার্টনার, চমৎকার শেয়ারহোল্ডার। গর্বসহকারে বলতে গেলে, আলিবাবা হচ্ছে আমাদের শেয়ারহোল্ডার। তারা বেশ উপকার করছে। আমাদের প্রযুক্তিবিষয়ক ভাবনায় বেশ বড় পরিবর্তন এনেছে তারা। একবারে শুরু থেকেই আমাদের ডিএনএতে প্রযুক্তি বিষয়টি ঢুকে গেছে। আলিবাবা মানেই সবার প্রথমে প্রযুক্তি। প্রযুক্তি দিয়ে শুরু, প্রযুক্তি দিয়ে শেষ। আর এই মনস্তত্ত্বটা আমাদের প্রতিষ্ঠানের শরীরজুড়ে একীভূত হচ্ছে। আমরা সত্যিকার অর্থেই ‘সবার আগে প্রযুক্তি’ (টেক-ফার্স্ট) কোম্পানি হয়েছি। আমি মনে করি, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। আর এই সংস্কৃতিটা আমরা আলিবাবা থেকে শিখেছি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আপনারা এখানে কী রকম ব্যবসা চান?
বিয়ার্কে মিকেলসেন: আমরা স্বাস্থ্যকর উপায়ে ব্যবসা করতে চাই। বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির একটা সমৃদ্ধিশালী ও বড় অংশ হচ্ছে ই-কমার্স। আপনাদের অঙ্গীকার করছি, কোনো সমস্যা হলে সব সময় ইউচ্যাট, ই–মেইল, লিংকডইনে যোগাযোগ করতে পারেন। কারণ, দারাজ হচ্ছে তা, যাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: তাহলে বলতে পারি আপনারা এখানে দীর্ঘ সময়ের জন্য এসেছেন।
বিয়ার্কে মিকেলসেন: আমরা এখানে দীর্ঘ সময়ের জন্য এসেছি। আমরা এখানে সঠিকভাবে ব্যবসা করতে চাই। কারণ, বাংলাদেশই ভবিষ্যৎ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: দক্ষিণ এশিয়ার বাজার কেন বেছে নিয়েছেন?
বিয়ার্কে মিকেলসেন: প্রথম কারণ জনসংখ্যা। দ্বিতীয় কারণ জিডিপি, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মধ্যবিত্তের উত্থান। অন্য বিষয়গুলো হচ্ছে ইন্টারনেটের উন্নয়ন ও অর্থ প্রদান। আমি বিশ্বের সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি, দক্ষিণ এশিয়া সেরা।