লিপস্টিকের আমদানি বাড়ল কেন

লিপস্টিক
রয়টার্স প্রতীকী ছবি

জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির রেকর্ড হচ্ছে। এক যুগের রেকর্ড ভেঙে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশের বেশি। এর মানে হলো, এক বছরের ব্যবধানে মানুষের খরচ সাড়ে ৯ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত তিন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। খরচ বাড়লেও আয় বাড়ছে না। এমন সময় কেনাকাটায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে ভোক্তাদের।

দেশের অর্থনৈতিক সংকটের এমন সময়ে শিল্পের কাঁচামাল থেকে প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমছে। সেটা স্বাভাবিকই। তবে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে একটি পণ্যের আমদানি ও ব্যবহার বাড়তে শুরু করেছে। এই পণ্য হলো লিপস্টিক। লিপস্টিকের আমদানি বৃদ্ধিই অর্থনীতিতে ভয় দেখাচ্ছে। ভয়টা মূলত পশ্চিমের ‘লিপস্টিক এফেক্ট’ তত্ত্বের কারণে। অবশ্য অর্থনীতির গতি কমার সঙ্গে মিলে গেলেও পশ্চিমা তত্ত্বে ভয় পাওয়ায় কিছু নেই বলে জানাচ্ছেন গবেষকেরা।

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার সময় লিপস্টিক তত্ত্ব আলোচনায় আসে। মন্দায় সাধারণত জিনিসপত্রের বিক্রি কমে যায়। তবে সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রসাধন কোম্পানি এস্টি লাউডারের চেয়ারম্যান লিওনার্দ লাউডার ঘোষণা দিলেন, এই মন্দায় লিপস্টিক বিক্রি আরও বেড়েছে। তিনি প্রথম ‘দ্য লিপস্টিক ইফেক্ট’ শব্দ ব্যবহার করেন। এই তত্ত্ব খুব জনপ্রিয় হয়। এর নেপথ্যে দুটি জোরালো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

যেমন মানুষের আয় কমলে বিলাসপণ্য কেনার চাহিদা কমে যায়। তবে কম বিলাসপণ্য কেনার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে মানুষ। আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, আর্থিক কষ্টের সময় নিজেকে পরিপাটি রাখার মধ্য দিয়ে কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করে মানুষ। তাতে মন্দার সময় লিপস্টিকের চাহিদা বেড়ে যায়। এ কারণে মন্দার আশঙ্কা বা পূর্বাভাস বোঝার জন্য লিপস্টিক বিক্রির ওপর চোখ রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদেরা।

বাংলাদেশে পণ্যভিত্তিক খুচরা বিক্রির হিসাব পাওয়া যায় না। তবে আমদানি থেকে লিপস্টিক বিক্রির চাহিদা বাড়ল না কমল, সে সর্ম্পকে ধারণা পাওয়া যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে ঠোঁটে ব্যবহারের উপকরণ বা লিপস্টিক-জাতীয় পণ্য আমদানি হয়েছে ৪০ হাজার ৭৭৫ কেজি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয় ২৬ হাজার ৮৫৩ কেজি। সরকারি হিসাবে, লিপস্টিক আমদানি ৫২ শতাংশ বেড়েছে।

আরও পড়ুন

আবার আমদানিমূল্যের হিসাবেও লিপস্টিক আমদানি বেড়েছে। যেমন চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে লিপস্টিক আমদানিতে শুল্কায়নমূল্য ছিল ৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে শুল্কায়নমূল্য ছিল ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আমদানিব্যয়ের হিসাবে লিপস্টিক আমদানি বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। আমদানি বাড়ায় সরকার আড়াই কোটি টাকা বেশি রাজস্ব পেয়েছে লিপস্টিক থেকে।

আমদানি বেড়ে যাওয়ার অর্থ দেশে লিপস্টিকের চাহিদা বেড়েছে। তবে বাংলাদেশ কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিজ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি মো. কবির ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ক্রয়ক্ষমতা কমলে প্রসাধনীর মতো বিলাসপণ্যের চাহিদা কমে যায়। প্রসাধনী বিক্রি তুলনামূলক কমেছে। প্রসাধনীর মধ্যে আলাদা করে লিপস্টিকের চাহিদা বাড়ল না কমল, সে সম্পর্কে আলাদা তথ্য তাঁদের কাছে নেই। আমদানি বাড়লেও বিক্রি বেড়েছে কি না, তা চার মাসের হিসাব দিয়ে বোঝা কঠিন। তবে বছর শেষের তথ্য দিয়ে ধারণা পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশে প্রসাধনীর বাজার আমদানি ও উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। লাগেজ বা অবৈধ পথে লিপস্টিকের মতো রঙিন প্রসাধনী বাজারে থাকলেও খুব বেশি নয় বলে জানিয়েছেন কবির ভূঁইয়া। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে এখন নানা ধরনের প্রসাধনী উৎপাদন বাড়লেও লিপস্টিক আমদানির ওপর নির্ভরতা বেশি।

বিলাসপণ্যের মধ্যে তুলনামূলক দাম কম লিপস্টিকের। ঠোঁট রাঙিয়ে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে লিপস্টিক অনন্য। অন্য প্রসাধনের চেয়ে বেশি সময় ব্যবহার করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও নারীদের মধ্যে লিপস্টিকের ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে। তবে পশ্চিমের লিপস্টিক ইফেক্ট তত্ত্ব কতটুকু মিলবে এ দেশে, তা নিয়ে সন্দিহান গবেষকেরা; যদিও খরচ সামলাতে মানুষ কম বিলাসপণ্যের দিকে ঝোঁকে বলে মনে করেন তাঁরা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতিতে যখন একধরনের অস্থিতিশীল প্রবণতা থাকে, তখন বিলাসপণ্যের মধ্যেও ভোক্তাদের ব্যয় সাশ্রয়ের প্রবণতা তৈরি হয়। প্রসাধনীর মধ্যে লিপস্টিক তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে লিপস্টিকের মতো পণ্যের ব্যবহার ও প্রাপ্যতা বেড়ে যায়। তিনি বলেন, লিপস্টিক আমদানি বা বিক্রি বাড়লে বাংলাদেশের জন্য মন্দাবস্থার ইঙ্গিত বলা যাবে না। তবে অর্থনীতির যে গতি কমছে, এটি তারই ইঙ্গিত বহন করে।

আরও পড়ুন