গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব
বড় চাপে ছোট বেকারি
আটা, ময়দা, সয়াবিন তেলসহ অধিকাংশ উপকরণের দাম চড়া। দফায় দফায় বেড়েছে জ্বালানির দাম। এসব চাপে ব্যবসা ছাড়ছেন অনেক বেকারির মালিক।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের চায়না বেকারি চার বছর ধরে উৎপাদনে থাকার পর সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় সব ধরনের কাঁচামাল ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে টিকে থাকতে না পেরে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন মালিক। এতে প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক প্রায় এক লাখ টাকার ব্যবসা যেমন নেই হয়ে গেছে, কাজ হারিয়েছেন অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ কাইয়ুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির সময় থেকে চাপটা শুরু হয়। এরপর গ্যাসের দাম বাড়ল। ব্যবসা টেকাতে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বন্ধই করতে হলো। ৭০ লাখ টাকার বিনিয়োগ ছিল। এর মধ্যে ৫০ লাখ টাকাই ব্যাংকঋণ। এখন দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে ঘুরছি।’
সরেজমিনে গতকাল বুধবার পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বিভিন্ন ছোট বেকারির মালিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপকালে এই শিল্পের বেকায়দায় পড়ার কথা জানা যায়। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, হস্তচালিত রুটি, বিস্কুট ও কেক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার ধাক্কা কাটিয়ে যখন ব্যবসায় ফিরতে শুরু করছিল, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। নিত্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজার চড়ে যায়। এর প্রভাবে দেশের বাজারে আটা, ময়দা, সয়াবিন তেলসহ বেকারিশিল্পের সব ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আবার বেড়েছে। এসব কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে ছোট ছোট বেকারিগুলো। অনেকে আবার পণ্যের দাম সমন্বয় ও উৎপাদন কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টায় আছে। কিছু প্রতিষ্ঠান সমজাতীয় বিকল্প ব্যবসার পরিকল্পনা করছে।
বাজারে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। তাতে ছোট ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দেওয়া না গেলে বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আর ফিরতে পারবে না; বরং আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে। কর্মসংস্থানও কমবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রুটি বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আরেক দফা জ্বালানির দাম বাড়িয়ে ছোট ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। সংশ্লিষ্টদের এটা বুঝতে হবে যে সবাই চাপের মধ্যে আছে। তবে ছোট ব্যবসায়ীদের চাপ সহ্য করার ক্ষমতা কম। এখন এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে।
সমিতির তথ্য অনুযায়ী, দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছয় হাজারের মতো ছোট-বড় বেকারি আছে। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে সারা দেশে ১০ শতাংশ বেকারি প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে ব্যবসা ছেড়েছে। আরও ২০ শতাংশের মতো বেকারি ব্যবসা ছাড়ার পরিকল্পনায় আছে। তারা ভালো বিকল্প খুঁজছে।
কাঁচামাল ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পর উৎপাদন কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টায় আছে, এমন বেকারিগুলোর একটি রাজধানীর শনির আখড়ার মনি ফুড প্রোডাক্টসের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। প্রতিষ্ঠানটির মালিক শহীদ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানির দাম, উৎপাদন খরচ, শ্রমিকের পারিশ্রমিক—সবকিছুতেই বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। কিন্তু দাম সমন্বয় হয়েছে সেই তুলনায় অপ্রতুল। ৫৫ জনবলের কারখানায় এখন কাজ করছেন ১৫ জন। বিক্রয়কর্মী ১৭ জন থেকে কমে ৫ জনে নেমেছে।
এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠী বেকারি পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে হস্তচালিত রুটি, বিস্কুট ও কেক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা কাঁচামাল আমদানি করে সেই মালামাল দিয়ে পণ্য তৈরি করার ফলে বাড়তি সুবিধা পায়। এ জন্য ছোট বেকারিগুলোর বাড়তি দামে ওই সব কোম্পানি থেকে কাঁচামাল কিনে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন।
বেকারির ব্যবসায়ীরা জানান, এ খাতের উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই কম শিক্ষিত। তাঁরা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কম দামের বিস্কুট, পাউরুটি, বানরুটি ও কেক উৎপাদন করেন। এ ধরনের পণ্যে তাই ভ্যাট পুরোপুরি উঠিয়ে দেওয়া উচিত। আর শ্রমঘন শিল্প হওয়ায় এ খাতে কর্মসংস্থানের হারও বেশ ভালো। তিন লক্ষাধিক মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে বেকারি খাতে।
বাংলাদেশ রুটি, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল হক বলেন, বাজারে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। তাতে ছোট ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দেওয়া না গেলে বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আর ফিরতে পারবে না; বরং আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে। কর্মসংস্থানও কমবে। এ ছাড়া মাঝেমধ্যেই বেকারিগুলোতে অভিযান হয়। এতে জরিমানা ও হয়রানির শিকার হন ব্যবসায়ীরা। হয়রানির উদ্দেশ্যে করা অভিযানের প্রতিকার চান তিনি।
একসময় পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক বেকারি ব্যবসা বেশ জমজমাট ছিল। সেখান থেকে শিল্প স্থানান্তর শুরু হলে অনেক প্রতিষ্ঠান সাভার, রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় কারখানা সরিয়ে নেয়। ভারী যন্ত্র ছাড়াই হাতে তৈরি বেকারি পণ্য বানায় এসব প্রতিষ্ঠান। সারা দেশের ছোট বেকারিগুলোও প্রায় একই মডেলে চলে। ঢাকার বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোও চাপে আছে।
দিনাজপুরের হৃদয় অ্যাগ্রোর মালিক মো. সাইফুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাপ-দাদার ব্যবসা বলে অনেকে এখনো ব্যবসা চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে ব্যবসা করার পরিস্থিতি নেই।
দেশের বিস্কুটের বাজার কত বড়, তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে একাধিক কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের মতে, বাজার প্রায় ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকার। এর মধ্যে ব্র্যান্ডের বিস্কুটের বাজার প্রায় অর্ধেক, ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। বাকি বাজার ছোট বেকারিগুলোর
হাতে। প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বিস্কুটের বাজার বড় হচ্ছে। তবে চলমান বাস্তবতায় প্রবৃদ্ধির এই হার কমবে বলে মনে করছেন বেকারি খাতের ব্যবসায়ীরা।