তরঙ্গের দাম টাকায় নিতে চিঠি

বাংলালিংক, গ্রামীণফোন ও রবি ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রায় তরঙ্গের দাম ঠিক করার অনুরোধ জানিয়ে বিটিআরসিকে চিঠি দিয়েছে।

দেশের মোবাইল অপারেটররা ১০ বছর পরে এসে স্পেকট্রাম বা তরঙ্গের দাম টাকায় ঠিক করতে চাইছে। এত দিন এই দাম মার্কিন ডলারে ঠিক করা ছিল।

বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশে ডলারের বিনিময় মূল্য অনেক বেড়ে যাওয়ায় নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে তরঙ্গের দাম বেশি হচ্ছে বলে জানিয়েছে তারা। সে জন্য ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় টাকায় তারা তরঙ্গের দাম দিতে চায় বলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। অপারেটরদের সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

বাংলালিংক, গ্রামীণফোন ও রবি গত ২২ অক্টোবর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যানকে স্থানীয় মুদ্রায় তরঙ্গের দাম ঠিক করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। তাতে জানায়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান বাদে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সবাই এখন স্থানীয় মুদ্রাতেই তরঙ্গের বিল পরিশোধ করে থাকে।

ডলারের বিনিময় মূল্য দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং এর অপর্যাপ্ততা বিবেচনায় বড় অঙ্কের পাওনা ডলারে পরিশোধ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
মোহাম্মদ জুলফিকার, মহাসচিব, অ্যামটব

বাংলাদেশে অবশ্য ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত স্পেকট্রাম বা তরঙ্গের ভিত্তিমূল্য স্থানীয় মুদ্রা টাকায় নির্ধারিত ছিল। পরে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতি মেগাহার্টজের তরঙ্গমূল্য দুই কোটি ডলার নির্ধারণ করা হয়।

অপারেটররা বলছে, তরঙ্গ ফি ডলারে নির্ধারণের কোনো যুক্তি নেই। তবে ২০১৩ সালে সরকার যখন এটা ডলারে নির্ধারণ করে দেয়, তখন অপারেটররা বিষয়টি নিয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। কারণ হিসেবে তারা বলছে, নিলামের তারিখ থেকে সে সময় ডলারের বিনিময় হারের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না।

কিন্তু ২০২১ সাল থেকে বিশ্ব্যব্যপী অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে ডলারের বিনিময় মূল্য ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে তরঙ্গের মোট দামও বাংলাদেশি মুদ্রায় হিসাব করলে ৩০ শতাংশ বেশি দিতে হচ্ছে বলে জানায় তিন মোবাইল অপারেটর। ভবিষ্যতে তা আরও বাড়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছে তারা।

মোবাইল অপারেটরদের চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, এটা নিয়ে বলার মতো কিছু হয়নি, কোনো সিদ্ধান্তও হয়নি।

অপারেটররা বলছে, তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয় বাংলাদেশি টাকায়। সেখানে তরঙ্গ ফি ডলারে প্রদানের কোনো যুক্তি নেই। তারা বলছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় মূল্য ঠিক করা হলে তা তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।

গ্রাহকদের ভালো সেবা দিতে তরঙ্গ খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু তরঙ্গ কেনার পেছনে ১ টাকা বিনিয়োগ হলে সেটা কাজে লাগানোর জন্য আরও আড়াই টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। তখন তাদের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যায়। তরঙ্গের দাম বাড়লে নেটওয়ার্ক উন্নয়নে বরাদ্দ কমে যায়। ফলে চাহিদা বেশি থাকা সত্ত্বেও অপারেটররা কম পরিমাণে তরঙ্গ সরবরাহ করে।

অপারেটররা বলছে, তরঙ্গের যথাযথ ব্যবহারের জন্য এর যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। অব্যবহৃত তরঙ্গের কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই। এমনকি বরাদ্দ করা তরঙ্গও অর্থনৈতিক মূল্য তৈরি করতে পারে না, যদি না তার সঠিক ব্যবহার হয়।

গ্রাহকপ্রতি মাথাপিছু আয় কমেছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেছে অপারেটররা। এ আয় ২০২১ সালে ছিল ১ দশমিক ৫০ ডলার, যা চলতি ২০২৩ সালে হয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ডলার। এ নিয়ে আলোচনার অনুরোধ জানিয়ে তারা বলেছে, স্থানীয় মুদ্রায় মূল্য পরিশোধের নীতি বর্তমান ও ভবিষ্যতের তরঙ্গ বরাদ্দসহ তরঙ্গ নবায়নের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য রাখা উচিত।

এক গবেষণার কথা উল্লেখ করে অপারেটররা বলছে, এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার ২৯টি দেশের মধ্যে ৪টি দেশ—বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ঘানা ও নাইজেরিয়াতেই শুধু তরঙ্গের মূল্য ডলারে পরিশোধ করতে হয়। বাকি দেশগুলো স্থানীয় মুদ্রায় তা শোধ করে।

সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার সম্মেলনেও বিষয়টি উত্থাপিত হয়। অপারেটররা তরঙ্গের জন্য বাংলাদেশি মুদ্রায় যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করতে বিটিআরসিকে আলোচনার অনুরোধ জানিয়েছে।

বিটিআরসি ২০২২ সালের ৩১ মার্চ সর্বশেষ তরঙ্গ বরাদ্দের নিলাম আয়োজন করে। তাতে দেশের চার অপারেটর মিলে ১০ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকার তরঙ্গ কিনেছিল। বর্তমানে অপারেটরদের মধ্যে তরঙ্গের পরিমাণ গ্রামীণফোনের ১০৭ দশমিক ৪০ মেগাহার্টজ, রবির ১০৪ মেগাহার্টজ, বাংলালিংকের ৮০ মেগাহার্টজ ও টেলিটকের ৫৫ দশমিক ২০ মেগাহার্টজ।

বিষয়টি নিয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব মোহাম্মদ জুলফিকার প্রথম আলোকে বলেন, মোবাইল অপারেটররা দেশীয় মুদ্রায় আয় করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই অভ্যন্তরীণ সব পাওনা তারা দেশীয় মুদ্রাতেই পরিশোধ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। ডলারের বিনিময় মূল্য দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং এর অপর্যাপ্ততা বিবেচনায় বড় অঙ্কের পাওনা ডলারে পরিশোধ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।