২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট ও আয়কর আইন (আইটিএ) ২০২৩-এর কিছু বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি)। সংগঠনটি মনে করে, আয়কর বিলটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী তৈরির চেষ্টা করা হলেও করপোরেটের ওপর করের চাপ বেড়ে যাবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হবে। যেহেতু দেশে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও এই আইন বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে, সেহেতু আইনটি পাস করার আগে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে কিছু জায়গায় পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
আজ বুধবার রাজধানীর বনানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ফিকির নেতারা। বিলের কিছু বিধান আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর বিবেচনায় অযৌক্তিক উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আশা ছিল, নতুন আইনে ন্যূনতম করের বিধানগুলো ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু সেটা তো করা হলো না, উল্টো সেগুলো উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়েছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হবে; কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়বে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, কোমল পানীয় শিল্পের (বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রি) ন্যূনতম কর শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ (৮ বৃদ্ধি) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ফলে কোমল পানীয়ের দাম ৩০ শতাংশেরও বেশি বাড়বে। এই খাতে ইতিমধ্যে ৫ থেকে ১০ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি ৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পরোক্ষ কর (এসডি ও ভ্যাট) দিতে হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে কোমল পানীয়ের বাজার কমবে এবং পরবর্তীকালে কর আদায় হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে এই বিল এ খাতের বিদেশি বিনিয়োগ পরিকল্পনা ও কর্মসংস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে। এ খাতের জন্য ন্যূনতম কর ১ শতাংশ নির্ধারণের অনুরোধ জানান ফিকির নেতারা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানিয়ে ফিকির সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় বলেন, ‘এই আইনের কিছু বিধান বাস্তবায়িত হলে ব্যবসা ও ব্যক্তির আয় প্রবৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মুঠোফোনের ওপর আরোপিত ভ্যাট ও লোকসানে থাকা কোম্পানিগুলোর ওপর করের বোঝা বৃদ্ধির কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে। সম্ভাব্য প্রতিকূল পরিস্থিতি এড়াতে আমরা কিছু সুপারিশ করেছি। আশা করছি, সুপারিশগুলো বিবেচনায় নিয়ে আমাদের করবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হবে।’
নাসের এজাজ আরও বলেন, আয়কর বিল অনুযায়ী শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা এখন থেকে ডব্লিওপিপিএফ, মিউচুয়াল ফান্ড ও ডিভিডেন্ড থেকে আয়ের ওপর ছাড় পাবেন না। লিভ ফেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্স (এলএফএ) এখন থেকে করের আওতায় আসবে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা কি আদৌ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে কি না এবং সেটা থেকে করছাড় পাওয়া যাবে কি না, সে বিষয়টি পরিষ্কার বলা নেই। দুই গাড়ির ক্ষেত্রে কার্বন করের বিষয়টি ভালো উদ্যোগ হলেও কোম্পানির ক্ষেত্রে কী হবে, সেটাও স্পষ্ট করা নেই—এগুলো স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
এ ছাড়া প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, প্রণোদনা বোনাস অতিরিক্ত লভ্যাংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। ফিকির পর্যালোচনা অনুসারে, এটি কোম্পানির ওপর করের বোঝা আরও বাড়িয়ে দেবে। পরবর্তীকালে কর্মচারীদের উপার্জনের ওপরও তার প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করে ফিকি। পরবর্তী পাঁচ বছরে ধীরে ধীরে শতভাগ নগদহীন লেনদেনের সক্ষমতা অর্জন করতে কোম্পানিগুলোর নগদ লেনদেনের নির্দিষ্ট সংখ্যা নির্ধারণ না করে বরং খরচের ন্যূনতম অংশ এ খাতে ব্যয় করার অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
ফিকির পরামর্শক ও হিসাববিদ স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, বেসরকারি খাতে স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিলে বা প্রভিডেন্ট ফান্ডে কর আরোপ করার ফলে মানুষের আয় কমবে, কিন্তু সরকারি ভবিষ্য তহবিলকে করমুক্ত রাখার বিষয়টি বৈষম্য সৃষ্টি করবে। ফিকি সরকারের কাছে বিধানটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানায়।
এ ছাড়া স্নেহাশীষ বড়ুয়া আরও বলেন, এই আইনের একটি নির্ভুল ইংরেজি সংস্করণ তৈরি করতে হবে, যাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ইংরেজি সংস্করণ পেয়ে নিজেরা আইনটি যাচাই–বাছাই করার সুযোগ পায়, তা না হলে তাঁরা বিনিয়োগ করার সাহস পাবেন না। এ ছাড়া প্রস্তাবিত আইনটি যাতে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর না হয়ে অন্তত ১ জুলাই ২০২৩ থেকে কার্যকর হয়, সেটা বিবেচনার জন্য ফিকির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে অনুরোধ জানান তিনি।
ফিকি মনে করে, সম্পত্তির ওপর বর্ধিত কর জনগণকে সরকারি দলিলে প্রকৃত সম্পত্তির মূল্য উল্লেখ না করে মৌজা হার উল্লেখ করতে উৎসাহিত করবে। সে জন্য তারা মনে করে, সম্পত্তি কর লেনদেনের খরচ বৃদ্ধির পরিবর্তে তা যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে আনা এবং বাজার মূল্য প্রতিফলিত করতে মৌজা মূল্যকে পর্যায়ক্রমে হালনাগাদ করা উচিত।
এ ছাড়া সংগঠনটি কর নির্ধারণে কর্মকর্তাদের ক্ষমতা হ্রাসের প্রস্তাব দিয়েছে। নিরবিচ্ছিন্ন লেনদেনের জন্য এনবিআরের তিনটি শাখা এবং বাইরে থেকে সংযুক্ত সিস্টেমগুলোর ডিজিটালাইজেশন করার পরামর্শও দিয়েছে তারা।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ফিকির নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবির। আরও বক্তব্য দেন ফিকির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি নেস্লে বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দীপাল আবেউইক্রেমা ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) সাজ্জাদ রহিম চৌধুরী, নেস্লে বাংলাদেশের আইন ও কর বিভাগের প্রধান দেবব্রত রায় চৌধুরী। উপস্থিত ছিলেন ফিকির পর্ষদ সদস্য আবদুর রহিম প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য বড় বরাদ্দের প্রশংসা করার পাশাপাশি স্বাস্থ্য, কৃষি ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দের অপ্রতুলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ফিকি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপও কম বলে মনে করে তারা।
ফিকি বাংলাদেশের ২১টির বেশি খাতে কাজ করা বিশ্বের ৩৫টি দেশের ২০৫টি বহুজাতিক কোম্পানি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শীর্ষ চেম্বার।