বাজারদর
বাজারে কোনো সুখবর নেই
প্যাকেটজাত চিনি ও আটা অধিকাংশ দোকানে নেই। বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও মুদিদোকানিরা বলছেন, ঘাটতি আছে।
রাজধানীর রামপুরা বাজারের একটি দোকানে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে স্থানীয় বাসিন্দা মো. মোস্তফা চাল কিনছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ দরদাম করে প্রতি কেজি ৬২ টাকা দরে ১০ কেজি বিআর ২৮ চাল কিনতে পারলেন। তারপর সবজি বাজারের দিকে এগোচ্ছিলেন।
তখনই মো. মোস্তফার সঙ্গে আলাপ। প্রথম আলোর প্রতিবেদককে জানালেন, দিনমজুরি করে মাসে হাজার বিশেক টাকা আয় করেন। তাঁর বাবা নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করে বেতন পান ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। তারপরও ছয় সদস্যের সংসারে চালাতে হিমশিম খেতে হয়। সে কারণে তাঁর স্ত্রী সম্প্রতি সেলাইয়ের কাজ শুরু করেছেন। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে খরচ সামলাতে চালাতে মো. মোস্তফা প্রথম নিজেও এখন বাড়তি আয়ের উৎস খুঁজছেন।
দিনমজুর মোস্তফার মতো স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর চাপ কেবল বাড়ছেই। রাজধানীর বাজারে সব ধরনের চালের দাম নতুন করে কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়েছে। খোলা আটার দামও বেড়েছে কেজিতে ২-৫ টাকা। বড় দানার মসুর ডাল কিনতে কেজিতে ৫-১০ টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে। এ ছাড়া আট, ময়দা, সয়াবিন তেল, পামতেল, রসুনসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দামই গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে।
অবশ্য বাজারে শুধু দাম নয়, কিছু পণ্যের সরবরাহেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেমন প্যাকেটজাত চিনি ও আটা অধিকাংশ দোকানে নেই। বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও মুদিদোকানিরা বলছেন, ঘাটতি আছে। দুই সপ্তাহ ধরে অধিকাংশ তেল পরিশোধনকারী কোম্পানি নতুন করে সয়াবিন তেল সরবরাহ করেনি। দ্রুত সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এসব পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কা খুচরা ব্যবসায়ীদের।
এদিকে বাজারে সাধারণ ভোক্তাদের জন্য কোনো সুখবর না থাকলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ঠিকই ইতিবাচক সংবাদ দিয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, গত অক্টোবরে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে সাড়ে ৮ শতাংশ হয়েছে। অথচ গত এক মাসে দু-তিনটি ছাড়া বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। যদিও বিবিএসের কর্মকর্তাদের দাবি, অক্টোবরে চালের দাম কমেনি, আবার বৃদ্ধিও পায়নি। তবে ভোজ্যতেলের দাম কমেছে। চাল-তেলের মূল্যবৃদ্ধি না পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কম হয়েছে।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে অবস্থা চলছে, তাতে দেশে ঘুষ-দুর্নীতির পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ যাতে অনৈতিকভাবে ব্যবসা করতে না পারে, সে জন্য তদারকি বাড়ানো প্রয়োজন। সরকার তো শুধু উন্নয়ন উন্নয়ন করে। আমি বলব, বর্তমান পরিস্থিতিতে উন্নয়নের প্রচার না করে মানুষের আয়রোজগার কীভাবে বাড়বে আর দ্রব্যমূল্য কীভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তা নিয়ে সরকারের ভাবা উচিত।’
বাজারে নিত্যপণ্যের দরদাম
নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে প্রথম আলোর তিনজন প্রতিবেদক গতকাল রাজধানীর তালতলা, মালিবাগ, রামপুরা এবং গুলশান-বাড্ডা লিংক রোডের কাঁচাবাজার ঘুরে দেখেন। প্রতিটি বাজারেই নিত্যপণ্যের দাম প্রায় কাছাকাছি।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে এক মাস আগে মোটা চাল (স্বর্ণা ও চায়না ইরি) ৪৮-৫২ টাকা, মাঝারি চাল (বিআর ২৮ ও পাইজাম) ৫২-৫৬ টাকা এবং সরু চাল (নাজিরশাইল ও মিনিকেট) ৬৪-৭৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। আর গতকাল মোটা চালের দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৩ টাকা, মাঝারি চাল ৫৬ থেকে ৬২ এবং সরু চাল ৬৫ থেকে ৮০ টাকা। গত কয়েক দিনে চালের দাম ২-৩ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চালের দাম বাড়লে গরিব মানুষ মাছ-মাংস, ডাল, ফলমূলের মতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়া কমিয়ে দেন। শাকসবজি খাওয়া বাড়িয়ে দেন তাঁরা। আবার গরিব মানুষ যত খরচ করেন, তার এক-তৃতীয়াংশ খরচ হয় চাল কিনতে। তাই চালের দামের কমবেশি হলে তার প্রভাব গরিব মানুষের ওপর বেশি পড়ে।
কেবল চালই নয়, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আটার দাম। খোলা কিংবা মোড়কজাত—কোনো আটাই বর্তমানে ৬০ টাকার নিচে নেই। গতকাল ঢাকার বিভিন্ন বাজারে মোড়কজাত প্রতি কেজি আটা বিক্রি হয়েছে ৬২-৬৬ টাকায়। ময়দার দামও বাড়তি। গত সপ্তাহে খোলা ময়দার কেজি ৬৫-৬৮ টাকা হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৭৫ টাকায়। তারপরও কিছু মুদিদোকানি ক্রেতাদের আটা কিংবা ময়দা কোনোটাই দিতে পারছেন না। বলছেন, সরবরাহ কম।
তালতলা এলাকায় গতকাল সকালে খোলাবাজারে বিক্রির (ওএমএস) দোকানে আটা কিনতে আসেন স্থানীয় বাসিন্দা সুফিয়া বেগম। বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে খালি হাতে ফেরেন। গতকাল আবারও লাইনে দাঁড়ান। ষাটোর্ধ্ব এই নারী বললেন, ‘আমার ডায়াবেটিস আছে। এ জন্য ভাতের বদলে দুই বেলা আটার রুটি খাই। বাজারে আটার দাম ৬০ টাকার বেশি। সে কারণে নিরুপায় হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে কম দামের আটা কিনতে আসছি।’
এক মাস আগে দেশি পেঁয়াজের কেজি ছিল ৪০-৪৫ টাকা। বর্তমানে ৫৫-৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা চীনা রসুনের দর বেড়ে ১৩০-১৪০ টাকা হয়েছে। মাসখানেক আগেও দাম ছিল ১১০-১৩০ টাকা। আবার গত মাসে মানভেদে আদার কেজি ছিল ৯০-১৮০ টাকা। আর বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৯০-২০০ টাকা কেজি দরে। মসুর ডালের দামও বাড়ছে। গত সপ্তাহে বড় দানার মসুর ডালের কেজি ছিল ৯৮-১০৫ টাকা। আর চলতি সপ্তাহে তা বিক্রি হচ্ছে ১০৫-১১০ টাকায়।
এদিকে চিনির দাম পাগলা গতিতে ছুটছে। গতকাল অধিকাংশ দোকানে মোড়কজাত চিনি মেলেনি। খোলা চিনিই বিক্রি হয়েছে ১১০-১১৫ টাকায়। অথচ এক মাস আগেও এই চিনি ৯০-৯৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আবার সয়াবিন তেলের সরবরাহ কমে যাওয়ায় এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৮০-১৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও বোতলের গায়ে লেখা দাম হচ্ছে ১৭৮ টাকা। বাড়তি দামের কারণ হিসেবে মুদিদোকানিরা বলছেন, তেল পরিশোধন কোম্পানিগুলো নতুন করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত না হওয়ার কারণে সয়াবিন তেল সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে।
অবশ্য বাজারে দু-তিনটি পণ্যে খানিকটা স্বস্তির খবরও আছে। গত মাসে প্রতি হালি ডিম বিক্রি হয় ৪৭-৫০ টাকায়। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৪৬ টাকায়। তা ছাড়া ব্রয়লার মুরগি গত মাসে ১৭০-১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও গতকালের দাম ছিল ১৬০-১৭০ টাকা।
জানতে চাইলে বাড্ডার মুদিদোকানি মেহেদি হাসান বললেন, ‘নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বিক্রি কমে গেছে। সাধারণ মাসের প্রথম দিকে বিক্রি বেশি হয়। আর মাসের শেষ দিকে হয় কম। তবে গত ১০ দিনে যা বিক্রি করেছি, তা স্বাভাবিক মাসের শেষের ১০ দিনের সমান। সব মিলিয়ে ২০-৩০ শতাংশ বিক্রি কমেছে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রায়ই দোকানে সয়াবিন তেল থাকছে না। তাতে বিক্রি আরও কমে যাচ্ছে। কারণ, ক্রেতারা যেখানে সয়াবিন তেল পায়, সেখান থেকেই বাকি পণ্যসামগ্রী কেনে। সব মিলিয়ে আগামী দিনে মাসে ৫০ হাজার টাকা দোকান ভাড়া দিয়ে ব্যবসা টেকানো কঠিন হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।’
নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, অনিশ্চিত বাজার পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা কঠিন। বর্তমান প্রেক্ষাপটি মেনে নেওয়ারও সময় এসেছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এখন সরকারের উচিত অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য চিহ্নিত করে সেগুলোর সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে যা যা করণীয়, তা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে।