তিন ক্ষেত্রে প্রস্তুতির ঘাটতি দেখছে আইএমএফ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল
ছবি: রয়টার্স

ভর্তুকি কমানো, কর সংগ্রহ বাড়ানো এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুতকে নির্দিষ্ট পরিমাণে উন্নীত করা—মোটাদাগে এ তিন পরামর্শ দিয়ে গতকাল রোববার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল তাদের বাংলাদেশ সফর বা স্টাফ কনসালটেশন মিশন শেষ করেছে।

বিষয় তিনটির ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি দেখছে আইএমএফ। ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের অনুমোদিত ঋণের যে দ্বিতীয় কিস্তি বাংলাদেশ আগামী ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা, তা যেন পায়, সে বিষয়ে সরকারকে জোর দেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে আইএমএফ বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদও ব্যক্ত করেছে। সংস্থাটি গতকাল বিবৃতি দিয়ে বলেছে, বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যারা দ্রুত হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। সংস্থাটি অবশ্য তিনটি চ্যালেঞ্জের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক আর্থিক খাতের অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়া এবং বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি।

আইএমএফের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের সফরটি গত ২৬ এপ্রিল শুরু হয়, শেষ হয় গতকাল। ১২ দিনের সফরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সব বিভাগ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ। বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি, দ্বিপক্ষীয় দাতা ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গেও বৈঠক করেছে দলটি। সফরের শেষ দিন গতকাল প্রতিনিধিদল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সঙ্গে।

আইএমএফকে জানানো হয়, কর আদায়ে ইএফডি কেনা হয়েছে, আরও কেনার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে বেসরকারি প্রতিনিধি (এজেন্ট) নিয়োগের পরিকল্পনাও রয়েছে।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এতে আইএমএফ ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী ভর্তুকি কমানোর কৌশলের কথা জানতে চেয়েছে। অথচ আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ভর্তুকির পেছনে বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কারণ কী? আবার কর আদায় জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়ানোর যে কথা রয়েছে, তার কৌশলই–বা কী? কর আদায়ে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) কেনাই কি যথেষ্ট? বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভই–বা কীভাবে জুনের মধ্যে ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলারে উন্নীত করা হবে?

বৈঠক শেষে আইএমএফ যেমন বিবৃতি দিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংক করেছে সংবাদ সম্মেলন। অবশ্য বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলনে ভর্তুকি ও কর-জিডিপির হারের কোনো প্রসঙ্গ উঠে আসেনি। অর্থ বিভাগ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি।

ভর্তুকি ব্যয় উল্টো বাড়ছে

বরাবরের মতো এ দফায়ও আইএমএফের মিশন বাংলাদেশের ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় যৌক্তিকীকরণ চেয়েছে। যৌক্তিকীকরণ মানে কার্যত ভর্তুকি কমানো। আইএমএফ মনে করে, ভর্তুকির অর্থ সরাসরি জনগণের দেওয়া করের টাকা। ভর্তুকি কমাতে পারা সরকারের জন্য ভালো। তখন এ টাকা সরকার অন্য কাজে ব্যয় করতে পারে।

অথচ চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে যে ভর্তুকি ছিল ৮২ হাজার কোটি টাকা, তা আগামী অর্থবছরে এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আইএমএফের নজরে এসেছে।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফকে জানানো হয়েছে যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) আর বাজেট সহায়তা দিতে হবে না। গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের জন্য সময়ভিত্তিক উপায় বের করা হবে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে। আর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে এবং আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নতুন ভর্তুকি বাড়বে না। তবে পুরোনোগুলোর জন্য ভর্তুকি থাকবে। আর এ কারণেই মোট অঙ্কে ভর্তুকি বাড়বে।

অথচ আইএমএফের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী আগামী ৩০ জুনের মধ্যে প্রকৃত রিজার্ভ উন্নীত হওয়ার কথা ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলারে। আইএমএফের মানদণ্ড অনুযায়ী আগামী সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের রিজার্ভ ২ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ ডলারের নিচে থাকতে পারবে না।

কর-জিডিপি বৃদ্ধির কৌশল কী

জানা গেছে, এবারের সফরে প্রথম দিনের বৈঠকের মতো গতকালও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে জিডিপির অনুপাতে কর বাড়ানো নিয়ে আইএমএফের দল বেশি প্রশ্ন করেছে। কর আদায়ে রাজস্ব খাতের সংস্কারে সরকার জোর দিক, এটা হলো আইএমএফের চাওয়া। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য আইএমএফ চায় কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি।

আইএমএফকে জানানো হয়, কর আদায়ে ইএফডি কেনা হয়েছে, আরও কেনার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে বেসরকারি প্রতিনিধি (এজেন্ট) নিয়োগের পরিকল্পনাও রয়েছে।

রিজার্ভ আরও কমছে

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ এখন ৩ হাজার ৯৮ কোটি ডলার। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল বাবদ ১১৮ কোটি ডলার পরিশোধের পর আজ সোমবার তা কমে ২ হাজার ৯৮০ কোটি ডলারে দাঁড়ানোর কথা।

রিজার্ভের অর্থে বিদেশে বিভিন্ন বন্ড, মুদ্রা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ; রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল গঠন; বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ কেনাবাবদ সোনালী ব্যাংককে ধার; পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খনন কর্মসূচিতে অর্থ দেওয়া এবং শ্রীলঙ্কাকে অর্থ ধার দেওয়া বাবদ মোট ৮২০ কোটি ডলার দেওয়া হয়েছে। আইএমএফ সব সময়ই বলে আসছে, এগুলো বাদ দিয়ে প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব রাখতে হবে। আইএমএফের মতে, এগুলো বাদ দিলে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়াবে ২ হাজার ১৭০ কোটি ডলারে।

অথচ আইএমএফের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী আগামী ৩০ জুনের মধ্যে প্রকৃত রিজার্ভ উন্নীত হওয়ার কথা ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলারে। আইএমএফের মানদণ্ড অনুযায়ী আগামী সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের রিজার্ভ ২ হাজার ৫৩০ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ ডলারের নিচে থাকতে পারবে না।

তিন চ্যালেঞ্জ

বিবৃতিতে আইএমএফ বলেছে, ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক আর্থিক খাতের অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়া ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি—এ তিন চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি, বিদেশি মুদ্রার মজুত ও স্থানীয় মুদ্রা টাকার ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে।

বিবৃতিতে প্রতিনিধিদলের প্রধান রাহুল আনন্দ বলেন, ‘এ সফরে আমরা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও আর্থিক খাতের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আইএমএফ-সমর্থিত কর্মসূচির মূল যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল, সেগুলো কতটা পূরণ হলো, তার অগ্রগতিও পর্যালোচনা করেছি।’ তিনি বলেন, বর্ধিত ঋণসুবিধা (ইসিএফ), বর্ধিত তহবিল সুবিধা (ইএফএফ) ও রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) ব্যবস্থার প্রথম পর্যালোচনায় আনুষ্ঠানিকভাবে তা মূল্যায়ন করা হবে, যা এ বছরের শেষের দিকে হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাজারভিত্তিক সুদহার জুলাইয়ে

গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে আইএমএফ বৈঠক করার পর অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বিকেলে কথা বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক।

আইএমএফের শর্ত হচ্ছে বাজারভিত্তিক সুদহার চালু করা। এ নিয়ে মেজবাউল হক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুনে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় এ বিষয়ে জানাবে। জুলাই থেকে তা কার্যকর হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রার একক বিনিময় হার চালুর দিকেও যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

বিনিময় হার চালু নিয়ে ব্যাখ্যা করে মেজবাউল হক বলেন, মুদ্রার একক বিনিময় হার মানে এই নয় যে ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়ের হার একই হবে। এখন একাধিক বিনিময় হার আছে। এগুলোর ব্যবধান ২ শতাংশের মধ্যে এলেই বলা যাবে মুদ্রার একক বিনিময় হার আছে। এটা প্রায় অর্জিত হয়েই গেছে। এখন তা আরও বেশি সীমার মধ্যে আনার চেষ্টা করা হবে। রিজার্ভ গণনার বিষয়েও আগামী মুদ্রানীতিতে ঘোষণা দেওয়া হবে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র।

বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের বিষয়ে বাংলাদেশের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফ কী বলেছে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মেজবাউল হক বলেন, ‘আইএমএফ এসব যৌথ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিষয়ে সন্তুষ্ট, যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সময় আছে। এগুলো আমলে নিয়ে আমরা সম্পূর্ণ সন্তুষ্টিতে কাজ করতে পারব।’

চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে মেজবাউল হক বলেন, ‘তা তো আপনারা জানেন। রিজার্ভ গণনা নিয়ে একটা বিষয় আছে। তবে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি যেসব দেশ সফর করেছেন, তারা সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সাহায্য এলে আমাদের রিজার্ভের হিসাব (ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) শক্তিশালী হবে।’

বাংলাদেশ চাওয়ার পর গত ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। স্বল্প সুদের এই ঋণের সঙ্গে ৩৮টির মতো শর্তও রয়েছে। শর্ত পূরণ হলে তারা পরের কিস্তি দেবে।

আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিজার্ভ বৃদ্ধি, কর-জিডিপি বৃদ্ধি ও ভর্তুকি কমানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বহু বছর ধরেই আমরা বলে আসছি, কিন্তু তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, এখন আইএমএফ বলছে এসব কথা। তবে এমনি এমনি বলছে না। ঋণ দেওয়ার বিপরীতে শর্ত দিয়েই বলছে। তাতেও দেখা যাচ্ছে কাজ হচ্ছে কমই। মূল সমস্যা কোথায়, এখন খুঁজতে হবে।

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, এত লক্ষ্য পূরণ করতে না পারলে আবার কিস্তি না আটকে যায়। একটা, দুইটা লক্ষ্য পূরণ না হলে তেমন কিছু হবে না। কিন্তু পূরণ না হওয়ার সংখ্যাটা বেশি হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বহির্বিশ্বের আস্থায় চিড় ধরার আশঙ্কা থাকে।