সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে ২৫% শুল্ক বসছে
সংসদ সদস্যদের আমদানি করা গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আগামী বাজেটে এই প্রস্তাব করা হতে পারে। এর ফলে সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি–সুবিধা পুরোপুরি থাকবে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বর্তমানে জাতীয় সংসদের সদস্যরা কোনো শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই গাড়ি আমদানি করতে পারেন। ৩৬ বছর ধরে এই সুবিধা পেয়ে আসছেন সংসদ সদস্যরা। ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তে সংসদ সদস্যদের সুবিধা কিছুটা প্রত্যাহার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
তবে শুধু আমদানি শুল্ক বসিয়ে কতটা রাজস্ব আদায় বাড়বে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেননা, গাড়ি আমদানিতে সবচেয়ে বেশি শুল্ক আসে সম্পূরক শুল্ক থেকে। বর্তমানে গাড়ির ইঞ্জিনের সিসিভেদে ৪৫ শতাংশ থেকে ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত সম্পূরক শুল্ক দিতে হয়।
এনবিআরের সূত্রগুলো বলছে, এবার শুধু ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানো হতে পারে। তবে সম্পূরক শুল্কসহ অন্যান্য কর মওকুফ থাকবে। গাড়ির দাম ও আমদানি শুল্কের যোগফলের ওপর সম্পূরক শুল্ক বসে। সংসদ সদস্যদের আনা গাড়ির ওপর আমদানি শুল্ক বসালেও তাঁরা ভালো সুবিধা পাবেন।
একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, নতুন প্রস্তাব পাস হলে কোনো সংসদ সদস্য যদি এক কোটি টাকা দামের গাড়ি (৪০০০ সিসির বেশি) আনেন, তাহলে তাঁকে ২৫ লাখ টাকা আমদানি শুল্ক দিতে হবে। কিন্তু একজন সাধারণ নাগরিক যদি ওই গাড়ি আনেন, তাহলে গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ ও ৫০০ শতাংশ সম্পূরক আরোপ হবে। ওই আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্কসহ আমদানিকারককে দিতে হবে সাড়ে ছয় কোটি টাকা।
এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানি কর বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথমেই সব সুবিধা প্রত্যাহার না করে কিছুটা শুল্কারোপের পথে যাচ্ছে এনবিআর। নীতিনির্ধারকেরা চাইলে ধীরে ধীরে সব সুবিধা প্রত্যাহার করা হবে।’
সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি–সুবিধা প্রথম দেওয়া হয় এরশাদ সরকারের আমলে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮ সালের ২৪ মে এ–সংক্রান্ত সুবিধা দিয়ে প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়। পরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেও এই সুবিধা বহাল রাখে। সব দলের সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি নিয়েছেন।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোক বলেন, এনবিআর এই প্রস্তাব করলে বৈষম্য কিছুটা হলেও কমবে। তবে পুরোপুরি কমবে না। সংসদ সদস্যদের বিনা শুল্কে গাড়ি–সুবিধা নৈতিকতা ও সংবিধানবিরোধী। অর্থনৈতিক সংকটের এই সময়ে ব্যয় সংকোচনের কথা বলা হচ্ছে, রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কথাও বলা হচ্ছে। তাই বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানির সুবিধা পুরোপুরি প্রত্যাহার করা উচিত।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘এনবিআর মনে হয় পরিপূর্ণ সাহসিকতার সঙ্গে প্রস্তাব করতে পারছে না। তাই শুধু আমদানি শুল্ক বসানোর কথা চিন্তা করছে। গাড়িতে শুল্কারোপ সবার জন্য সমান করা উচিত।’
কোন আমলে কতজন সুবিধা নিয়েছেন
জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তখনকার পঞ্চম সংসদের (১৯৯১-৯৬) ৩০১ জন সদস্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আনেন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পর ষষ্ঠ সংসদ গঠিত হয়েছিল। মেয়াদ অল্প থাকায় ওই সংসদের কোনো সদস্য এই সুবিধা নিতে পারেননি।
পরে ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ওই সময়ে গঠিত সপ্তম সংসদের ১৭৬ জন সদস্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আনেন। পরে ২০০১-০৬ মেয়াদের অষ্টম সংসদে সব মিলিয়ে এসেছে ৩১১টি শুল্কমুক্ত গাড়ি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসে। ওই নবম সংসদের সব মিলিয়ে ৩১৫ জন সদস্য শুল্কমুক্ত গাড়ি এনেছেন।
এ ছাড়া দশম (২০১৪-১৮) এবং একাদশ (২০১৯-২৩) সংসদের মেয়াদে কতটি শুল্কমুক্ত এসেছে, তার আনুষ্ঠানিক তথ্য মেলেনি। তবে ওই দুটি সংসদেই তিন শতাধিক শুল্কমুক্ত গাড়ি এসেছে বলে এনবিআরের সূত্রগুলো জানিয়েছে।
বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কোনো সরকারই বিধানটি বাতিল করেনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শুল্কমুক্ত গাড়ির অপব্যবহার রোধে নানা উদ্যোগের কথা শোনা গিয়েছিল। সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার সুবিধা না দিয়ে সরকারি পুল থেকে তাঁদের গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার কথাও তখন বলা হয়েছিল। শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির ব্যবস্থা বাতিল না হলেও নিয়মকানুন কিছুটা কঠোর করা হয়েছে।