রোজার পণ্য আমদানি এখন পর্যন্ত কম, উদ্যোগ বেড়েছে

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার নির্ধারিত দামে পাওয়া যাচ্ছে না। কারখানা চালাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো দরকার।

দেশে গম, ভোজ্যতেল, চিনিসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের আমদানি এখনো কম। তবে আমদানির উদ্যোগ বেড়েছে। অর্থাৎ, এসব পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংকে ঋণপত্র খেলা বেড়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, পবিত্র রমজান মাস আসতে এখনো দেড় মাসের মতো সময় আছে। এ সময়ে আমদানি বাড়লে পণ্যের সরবরাহে সমস্যা হবে না। বিশ্ববাজারে দাম কিছুটা বাড়তি। সরকার যদি শুল্কছাড় দেয়, তাহলে দেশে দাম স্থিতিশীল রাখা যাবে। তবে মার্কিন ডলারের দাম নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে।

যেমন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, গত ১ নভেম্বর থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাবে দেশে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি কমেছে ৪৪ শতাংশ (দেশে প্রবেশের হিসাব)। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ১ নভেম্বর থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সয়াবিন বীজ আমদানির ঋণপত্র ৯৪ শতাংশ এবং অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের ঋণপত্র ২৯ শতাংশ বেড়েছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় নিত্যপণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, রোজার আগে আরও পণ্য আসবে। চাহিদাও কিছুটা কম। ফলে সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, রোজার বাজার স্থিতিশীল রাখতে মার্কিন ডলারের বিনিময়মূল্য ঠিক রাখতে হবে। কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ১ নভেম্বর থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সয়াবিন বীজ আমদানির ঋণপত্র ৯৪ শতাংশ এবং অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের ঋণপত্র ২৯ শতাংশ বেড়েছে।

কতটা আমদানি হয়েছে

রোজায় বেশি চাহিদা থাকে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, মটর ডাল, মসুর ডাল, পেঁয়াজ ও খেজুরের। গমের চাহিদা সব সময়ই থাকে। এসব পণ্যের বেশির ভাগের চাহিদা মেটে আমদানি করে।

রোজায় ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে বেশি। ব্যবসায়ীদের হিসাবে এই চাহিদা অন্তত সাড়ে তিন লাখ টন। ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন আমদানি কমলেও পাম তেল আমদানি বেড়েছে। তবে সয়াবিন ও পাম—দুই ধরনের তেল আমদানিতেই ঋণপত্র বেড়েছে।

রোজায় চিনির চাহিদাও অনেকটাই বেড়ে যায়। দেশেও চিনির দাম এখন চড়া। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেশি। দাম বাড়ার একটি কারণ আমদানি কম। গত নভেম্বর থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অপরিশোধিত চিনি আমদানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ শতাংশ কমেছে। তবে ঋণপত্র খোলা বেড়েছে ১৪ শতাংশ।

ডলার–সংকট ও ডলারের দাম নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। আবার সীমান্তে চিনি চোরাচালান বেড়েছে। এতে বৈধ পথে শুল্ককর দিয়ে পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
বিশ্বজিৎ সাহা, নিত্যপণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক

দেশের শীর্ষস্থানীয় আরেকটি নিত্যপণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ডলার–সংকট ও ডলারের দাম নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। আবার সীমান্তে চিনি চোরাচালান বেড়েছে। এতে বৈধ পথে শুল্ককর দিয়ে পণ্য আমদানিতে ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, পণ্য আমদানিতে ব্যয় বাড়লেও ব্যাংকে গ্রাহকের একক ঋণসীমা বাড়েনি। কয়লা ও জ্বালানির মতো নিত্যপণ্য আমদানিতেও অন্তত ভালো গ্রাহকের জন্য একক ঋণসীমা তুলে নিলে আমদানি বাড়বে।

রোজায় ছোলা, মসুর ডাল ও মটর ডালের চাহিদা বেশি থাকে। ছোলার আমদানি বেড়েছে অনেকটাই। তবে মসুর ও মটর ডালের আমদানি বাড়েনি। যদিও ঋণপত্র বেড়েছে।

ভারত গত ডিসেম্বরে রপ্তানি নিষিদ্ধ করার পর বিকল্প বাজার থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়। তবে খুব বেশি আসছে না। ফলে আমদানি কমেছে। দেশের বাজারে দামও বেশি, মানভেদে কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ৯০ টাকা। গত বছর একই সময়ে দর ছিল কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজায় নতুন মৌসুমের হালি পেঁয়াজের (বীজ থেকে উৎপাদিত) ভরা মৌসুম থাকবে। তবে আমদানি না হলে দাম খুব একটা কমার আশা কম।

বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের যে দর নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই দরে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংক একেকজনের কাছে একে দর চাইছে। এতে নিত্যপণ্যে যে প্রতিযোগিতা, তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আবুল বশর চৌধুরী, বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান

বিশ্ববাজারে দর কিছুটা বাড়তি

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। অবশ্য যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পর দাম কমতে থাকে। তবে বাংলাদেশে সুফল সামান্যই পাওয়া গেছে। কারণ, দেশে মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি খরচ বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মে মাসে মার্কিন ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকার আশপাশে। এখন তা কাগজে–কলমে ১১০ টাকা। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানির ক্ষেত্রে ডলার কিনতে ১২৪ টাকার মতো দাম দিতে হচ্ছে। ডলারের দাম যতই বাড়ছে, পণ্যে করভার ততই বাড়ছে। কারণ, শুল্ক আরোপ হয় শতাংশ হারে।

নিত্যপণ্যের আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের যে দর নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই দরে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংক একেকজনের কাছে একে দর চাইছে। এতে নিত্যপণ্যে যে প্রতিযোগিতা, তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

খেজুর আমদানিকারক মালিক প্রথম আলোকে বলেন, কার্টনে আনা জাহিদি খেজুরের বিশ্ববাজারে দাম প্রতি টন ৮০০ ডলার। কাস্টমস শুল্কায়ন করছে টনপ্রতি আড়াই হাজার ডলারে। এখন কেজিতে শুল্ককর দিতে হচ্ছে ১৩২ টাকা, যেটি আগে ছিল না।
ফারুক আহমেদ , ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের খেজুর আমদানিকারক মালিক

বিশ্ববাজারে সাম্প্রতিককালে সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি ও ডালজাতীয় পণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে।

যেমন অপরিশোধিত চিনির দাম গত বছর টনপ্রতি ৬৫০ ডলার উঠেছিল। সেখান থেকে কমে ৫৪০–৫৮৬ ডলারে নেমে যায়। এখন আবার বেড়ে ৬৪০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চিনি আমদানি হয়েছে ৬১০ থেকে ৬৬০ ডলারে। ভোজ্যতেলের দামও টনপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ ডলার বেড়েছে।

যেমন সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় ইরাকের জাহিদি খেজুর। এই খেজুর গত বছর রোজার আগে খুচরায় প্রতি কেজি ১৩০–১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। এবার দাম বেড়ে ২৫০ টাকা হয়েছে।

খেজুর আমদানিকারক ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কার্টনে আনা জাহিদি খেজুরের বিশ্ববাজারে দাম প্রতি টন ৮০০ ডলার। কাস্টমস শুল্কায়ন করছে টনপ্রতি আড়াই হাজার ডলারে। এখন কেজিতে শুল্ককর দিতে হচ্ছে ১৩২ টাকা, যেটি আগে ছিল না।

শুল্ক কমলে কি দাম কমবে

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের ওপর শুল্ককর কমানোর অনুরোধ জানিয়ে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে এনবিআরকে। গতকাল এনবিআরের এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কর্মকর্তারা জানান, তাঁরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্ককরে কতটুকু ছাড় দেওয়া হবে, তার ওপর দাম কতটা কমতে পারে, তা নির্ভর করছে।

সার্বিক বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এখন ডলার–সংকট চলছে। স্বাভাবিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নেই। এমন পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যালোচনা করতে হবে।