বিনিয়োগে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা সমাধানের আহ্বান কোরীয় ব্যবসায়ীদের

বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি খাতে বিদেশি বিনিয়োগের বড় সম্ভবনা রয়েছে। তবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে সরকারকে একটি কার্যকর বিনিয়োগ নীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে, সেগুলোর সমাধান করা জরুরি। পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়াসহ কৌশলগত সম্পর্কের দেশগুলোর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা আজ রোববার এক সেমিনারে এসব কথা বলেন। বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনাকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) ও কোরিয়ান দূতাবাস যৌথভাবে সেমিনারটির আয়োজন করে। রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘কোরিয়া-বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সহযোগিতা’ শীর্ষক এ সেমিনারে দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যৎমুখী অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্প এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।

উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ‘আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশ ও কোরিয়ার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আমি কোরিয়ার ব্যবসায়ীদের এ দেশে আরও বিনিয়োগের আহ্বান জানাই।’

বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ‘দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আমাদের নীতি ও কাঠামোগত অনেক পরামর্শ দিচ্ছেন। আমরা সেগুলো আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করছি। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আমরা পাচ্ছি। এগুলো পর্যায়ক্রমে সমাধান করা হবে।’

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কোরিয়া ট্রেড-ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন এজেন্সির (কোট্রা) মহাপরিচালক স্যামসো কিম। এতে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অটোমোবাইল, জাহাজ নির্মাণ, ব্যাটারি রিসাইক্লিং, বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরিসহ কয়েকটি খাতে বিদেশি বিনিয়োগের বড় সম্ভাবনা রয়েছে। স্যামসো কিম আরও বলেন, এক দরজায় সেবা (ওএসএস) পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা জরুরি।

দুই দেশের মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির (ইপিএ) তাৎপর্য তুলে ধরেন বাংলাদেশ নিযুক্ত দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং সিক। তিনি বলেন, কোরিয়ার তৈরি পোশাকের বাজারে বড় হিস্যা রয়েছে চীন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার। তিনটি দেশের সঙ্গেই কোরিয়ার এফটিএ রয়েছে। অন্যদিকে কোরিয়ার তৈরি পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা এখনো অনেক কম। ফলে দুই দেশের মধ্যে এফটিএ বা ইপিএ বাস্তবায়ন হলে এ হিস্যা বাড়বে। পাশাপাশি বাংলাদেশে কোরীয় বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে। তবে এফটিএ না হলেও কোরিয়া বাংলাদেশে বিনিয়োগ বন্ধ করবে না বলে জানান তিনি।

পার্ক ইয়ং সিক আরও বলেন, ২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে (এলডিসি) উত্তরণের কথা রয়েছে। ফলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি ও অন্যান্য কাজের জন্য বাংলাদেশের হাতে খুব বেশি সময় নেই। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বেশ কিছু জায়গায় সংস্কার আনা ও বিভিন্ন সেবা সহজ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের উচিত হবে তৈরি পোশাক খাতে নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করা।

ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব ব্লক আরসিইপিতে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় নথিপত্র জমা দিয়েছে। বিষয়টি ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, আরসিইপিতে যোগ দিলে বাংলাদেশের রপ্তানি, বিদেশি বিনিয়োগ ও মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)—সবই বাড়বে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেন কোরিয়ার পোশাক কোম্পানি প্রাইম ক্যাপের (বিডি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সু মিন কো। বাংলাদেশে ৩৫ বছর ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, এখানে ব্যবসা ও বিনিয়োগের প্রক্রিয়া বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। পাশাপাশি অতিরিক্ত খরচ ও কম উৎপাদনশীলতার সমস্যাও রয়েছে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে ছাত্র আন্দোলন ও পরবর্তী সময়ের কথা তুলে ধরে সু মিন কো বলেন, ‘এই সময়ে আমার প্রতিষ্ঠানে ১১৯ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। আট দিন নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ বন্ধ করতে হয়েছে এবং সার্বিকভাবে ১০ শতাংশ উৎপাদনশীলতা কমেছে। আমার ধারণা, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ওই সময়ে এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। আমি আশা করব, এ ধরনের পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।’

স্বাগত বক্তব্যে ফরেন চেম্বারের সভাপতি জাভেদ আখতার জানান, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে তাঁরা এ সেমিনারের আয়োজন করেছেন।

বাংলাদেশ-কোরিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (কেবিসিসিআই) সভাপতি শাহাব উদ্দিন খান বলেন, কোরিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে বড় বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে। আশার কথা, কোরিয়ার ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি পণ্য কেনার বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এ সুযোগ নিয়ে রপ্তানি বাড়াতে পারলে বাংলাদেশের বাণিজ্যঘাটতি কমানো সম্ভব হবে।