সকালে ‘গরম’ বাজার
বসন্তের সকাল। তবু কুয়াশা মোড়ানো। শীতও আছে হালকা হালকা। সোয়া আটটার দিকে গুলশান-বাড্ডা লিংক রোডের কাঁচাবাজারে গিয়ে মুরগির দরদামের খোঁজখবর নিতে উত্তাপটা টের পাওয়া গেল। ব্রয়লার মুরগির কেজি ২৩০। একদাম। আর সোনালি? সে তো ত্রিপল সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে গেছে। কেজি ৩৩০ টাকা।
যাঁরা এক সপ্তাহ পর আজ শুক্রবার সকালে বাজারে গিয়েছেন, তাঁরা তো দাম শুনে চোখ কপালে তুলছেন। কারণ, গত সপ্তাহেও ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকার কাছাকাছি ছিল। আর সোনালি মুরগির দাম ছিল ৩০০ টাকার ঘরে। ভাবলাম, আরেকটু খোঁজখবর নেওয়া যাক। গেলাম আরেক দোকানে। কিশোর বিক্রেতা, নাম রমজান মিয়া। দাম চাইলেন ব্রয়লারের কেজি ২৪০ টাকা। আর সোনালি ৩২০।
দাম এত কেন, জিজ্ঞাসা করলে বললেন, ‘মুরগির খাবারের দাম বাড়তি। আমরা কী করমু। আমাগো তো বেশি দামে কিনতে হইতাছে।’ তাঁর স্বগতোক্তি, ‘ব্রয়লার মুরগির দাম ২০০ টাকার উপ্রে গেছে জীবনে দেহি নাই।’
বাজারে হাঁটছি, হঠাৎ এক মাংস বিক্রেতা হাঁক দিলেন, ভাই, মাংস লাগব, আসেন। ভালো গরুর মাংস। দাম জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘ভাই, বেশি না। মাত্র ৭২০ টাকা কেজি।’ নিজের অজান্তেই দোকানিকে বললাম, ‘বলে কী! ৭২০ টাকা কেজি গরুর মাংস; এই দাম আবার বেশি না।’ ওই সময় খেয়াল করলাম মুঠোফোনে একটা খুদে বার্তা (মেসেজ) এল। দেশের একটি সুপারশপের খুদে বার্তা। তারা প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬৯৫ টাকায় বিক্রি করছে।
মাংসের বাজারের এই হাল দেখে ঢুকলাম মাছের বাজারে। অন্য মাছে দিকে না তাকিয়ে সোজা পাঙাশ বিক্রেতার কাছে গেলাম। দোকানি কেবল বিক্রির জন্য পাঙাশ সাজাচ্ছেন। এক গামলায় কিছু মরা পাঙাশ (আকারে ছোট)। আরেক গামলায় মাঝারি আকারের জীবিত পাঙাশ। দরদাম জানতে চাইলাম। দোকানি বললেন, ‘বড়টা (মাঝারি আকারে জীবিত পাঙাশ) ১৮০ টাকা। আর ছোটটা (ছোট আকারের মরা পাঙাশ) ১৬০ টাকা। পাঙাশের এত দাম?’ দোকানি মাছ সাজাতে সাজাতে বললেন, ‘সবকিছুর দাম বাড়তি। নিলে নেন নাইলে না নেন। কিচ্ছু করার নাই।’
ভাবলাম, তেলাপিয়ার একটু খোঁজ নেওয়া যাক। সেখানে হয়তো সুখবর মিললেও মিলতে পারে। এক দোকানি মাঝারি আর ছোট আকারের তেলাপিয়া নিয়ে বসেছেন। ‘দাম কত?’ কিছুটা গম্ভীর স্বরে বললাম। দোকানি বললেন, ‘বড়ডা ২০০। আর ছোডোডা ১৮০। কোনোটা দিমু?’ বললাম, ‘কমটম কিছু হবে?’ দোকানি এবার গলার স্বর বদলে বললেন, ‘আটানা (আট আনা) কম চাইলও দেওন যাইব না।’
গুলশান–১ নম্বর গোলচত্বর থেকে গুলশান-বাড্ডা লিংক রোডের বাজারের দূরত্ব আধা কিলোমিটারের কম–বেশি হবে। ঝিলের এক পাড়ে গুলশান। আর আরেক পাড়ে বাড্ডা। অভিজাত এলাকার পাশের বাজার, তাই হয়তো জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেশি। যা হোক, কারওয়ান বাজারের দিকে রওনা দিলাম।
প্রথমে রিকশা, তারপর হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসে, তারপর আবার রিকশাযোগে আধা ঘণ্টায় রাজধানীর অন্যতম পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজারে আসা গেল। যেহেতু পাইকারি আর খুচরা বাজার গাঁ ঘেঁষাঘেঁষি অবস্থায় আছে তাই দাম কিছুটা কম। কথাটা কিছু পণ্যের বেলায় সত্য। তবে সব পণ্যের বেলায় নয়।
রাস্তার ওপর ডিমের খাঁচা নিয়ে বসে আছেন কয়েকজন বিক্রেতা। ‘দাম কত?’ একজন দোকানি বললেন, ‘ফার্মের মুরগির ডিমের ডজন ১৪০। আর হাঁসের ডিমের ডজন ২১০ টাকা।’ শুরু করলাম দরদাম। শেষ পর্যন্ত ফার্মের ডিমের ডজনে ৫ টাকা কমে দিতে রাজি হলেন বিক্রেতা। তাঁর নাম রহমত আলী। জিজ্ঞাসা করলে বললেন, ‘দাম বাড়ার কারণে বিক্রি কমে গেছে। দুই–তিন সপ্তাহ আগে দিনে দেড় হাজার ডিম বিক্রি করতাম। এখন দাম বেড়ে যাওয়ায় ১ হাজার করতেই কষ্ট হয়ে যায়।’
ডিম বিক্রেতাদের পাশেই কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেট। তার নিচে মুরগির দোকান সারি সারি। এক দোকানে জানতে চাইলাম, ‘ব্রয়লারের দাম কত?’ ‘২৩০ টাকা’। ‘আর সোনালি?’ ‘৩১০ টাকা’। ‘এত দামের কারণ কী?’ দোকানি আনোয়ার হোসেন ওরফে সুজন বললেন, ‘ব্রয়লার কিনছি ২২২ টাকা কেজি। আর সোনালি ২৯৫ টাকা। এখন আপনিই বলেন, দাম কী বেশি চাইছি?’ উত্তর কী দেব ভাবছি। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বিক্রি কেমন হচ্ছে?’ দোকানি বললেন, ‘ব্রয়লার মুরগি গরিবের খাবার। কিন্তু গরিবেরাও এখন ব্রয়লার কেনার সামর্থ্য নাই। দাম জিজ্ঞাসা করে। তারপর চলে যায়।’
দুই-চারটি দোকান পরে ফুটপাতে তিন-চারজন ব্যবসায়ী মুরগির পা আর গিলা কলিজা নিয়ে বসে আছেন। তাঁদের দেখা গেল কিছুটা ব্যস্ত। দাম জানতে চাইলে একজন দোকানি বললেন, ‘মুরগি পা ১৫০ টাকা। আর গিলা কলিজা ১৬০ টাকা।’ ভাবলাম, এক শ পিচে দাম হয়তো বলছেন বিক্রেতা। নিশ্চিত হতে জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন, ‘না ভাই। এক কেজি মুরগির পায়ের দাম দেড় শ।’
কী বলব বুঝতে পারলাম না। দ্রুত হাঁটা দিলাম, মাছের বাজারের দিকে। ঢুকতেই ইলিশ, বড় রুই-কাতল, মাগুর, চিংড়িসহ নামীদামি মাছ। পাঙাশের খোঁজ পাচ্ছি না। এক দোকানিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পাঙাশ কই পাওয়া যায়?’ বললেন, ‘ভেতরে যান।’ যা–ই হোক, খানিকটা হেঁটে খুঁজে পেলাম কাঙ্ক্ষিত মাছ। সুনীল নামের এক দোকানি বললেন আড়াই কেজি ওজনের পাঙাশের দাম ২০০ টাকা কেজি। আর দেড় কেজি ওজনের পাঙাশের দাম ১৭০ টাকা কেজি।
দামের যে অবস্থা, তাতে পাঙাশ মাছকেও এখন বাগে আনতে কঠিন হবে নিম্ন আয়ের মানুষের। খোঁজ করলাম তেলাপিয়ার। মো. রবীন নামের এক বিক্রেতার দেখা মিলল। বললেন, এক দাম ২০০ টাকা কেজি। দাম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলে বিক্রেতা করলেন, ‘আমাদের কিছুই করার নেই। সবকিছুর দাম বাড়তি। তেলাপিয়ার দামও বাড়ছে। তবে দাম বাড়ার কারণে বিক্রি কমে গেছে। আগে দিনে ৭০-৮০ কেজি বিক্রি হলেও এখন ৪০-৫০ কেজির বেশি পারতেছি না।’
মাছ-মাংসের দামের উত্তাপে ততক্ষণে শীত উধাও। গরম লাগতে শুরু করছে। বাজার থেকে বের হতে দুজন টিভি সাংবাদিকের দেখা মিলল। তাঁরা মাছ বিক্রেতাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। তখন পাশ থেকে একজন মিন্তি (শ্রমিক) বললেন, ‘বাজারে কাস্টমারের চাইয়া (চেয়ে) সাংবাদিকই দেখাতাছি বেশি।’