আর্জেন্টিনার মানুষ গরুর মাংস কম খাচ্ছেন কেন

স্টেকহাউস, বিশাল সব গরুর খামার আর আসাদো বারবিকিউর জন্য বিশেষ পরিচিতি রয়েছে আর্জেন্টিনার। তবে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটির মানুষেরা এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় কম পরিমাণ গরুর মাংস খাচ্ছেন। এর কারণ, তাঁরা ব্যয়ে সাশ্রয়ী হতে বাধ্য হয়েছেন।

রয়টার্স জানায়, আর্জেন্টিনায় তিন অঙ্কের মূল্যস্ফীতি চলছে। পাশাপাশি চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। ফলে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত আর্জেন্টাইনরা গরুর মাংস খাওয়া কমিয়েছেন ১৬ শতাংশ। দেশটির সমাজে গরুর মাংসের বিশেষ গুরুত্ব আর ঐতিহ্য রয়েছে, যে ঐতিহ্যের তালিকায় আরও রয়েছে ফুটবল ও মাতে চা।

আর্জেন্টিনার অনেক মানুষের বাড়িতেই মাংস গ্রিল করার ‘পারিয়া’ রয়েছে, যেখানে পরিবারের সদস্যরা জড়ো হন। বুয়েনস এইরেসের আনাচকানাচে রয়েছে স্টেকহাউস, যেকোনো রাস্তায় গেলেই এগুলো দেখা যায়। আর যেখানে–সেখানে গড়ে তোলা হয় বারবিকিউ করার ব্যবস্থা, এমনকি নির্মাণস্থল কিংবা জনসভার আশপাশে। উদ্দেশ্য একটাই, গরুর মাংসের স্বাদ নেওয়া।

এক কসাইয়ের দোকানের বাইরে ৬৬ বছর বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী ক্লদিয়া সান মার্টিন রয়টার্সকে বলেন, গরুর মাংস আর্জেন্টিনার খাবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইতালীয়দের জীবন থেকে পাস্তা সরিয়ে নিলে যেমনটা হবে, আর্জেন্টাইনদের জীবন থেকে গরুর মাংস সরিয়ে নিলে ঠিক তা–ই হবে। তিনি আরও বলেন, তিনি অন্যান্য খাত থেকে খরচ কমাতে রাজি আছেন, কিন্তু গরুর মাংসে হাত দেওয়া যাবে না।

ক্লদিয়া সান মার্টিন বলেন, ‘বর্তমানে যেমন কঠিন সময় চলছে, তেমন কঠিন সময়ে আর্জেন্টাইনরা যেকোনো জিনিস বাদ দিতে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু মাংস ছাড়া আমাদের চলে না।’

তবে পরিস্থিতি এখন আর্জেন্টিনাবাসীকে বাধ্য করছে সেই গরুর মাংস খাওয়া কমাতে। সম্প্রতি প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত আর্জেন্টাইনরা গড়ে যে পরিমাণ গরুর মাংস খেয়েছেন, একই হারে এই ভোগ চললে তা হবে বছরে ৪৪ কেজি বা ৯৭ পাউন্ডের সমপরিমাণ। গত বছর এই পরিমাণ ছিল ৫২ কেজি। ১৯৫০-এর দশকে আর্জেন্টিনার মানুষ বছরে ১০০ কেজি গরুর মাংস খেত।

গরুর মাংসের ভোগ কমে যাওয়ার একটি কারণ হলো অন্যান্য মাংসের দিকে ঝোঁকা, যেমন শূকরের মাংস ও মুরগি। অনেকে সস্তার খাবার, যেমন পাস্তার দিকে নজর দিয়েছেন। তবে চলতি বছরে গরুর মাংস খাওয়া কমে যাওয়ার মূল কারণ দেশটির প্রায় ৩০০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি এবং প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেইয়ের কৃচ্ছ্র কর্মসূচির পাশাপাশি থমকে যাওয়া অর্থনীতি।

দারিদ্র্য বেড়েছে। বড় বড় শহরে আগের চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ এখন গৃহহীন। আর সস্তার খাবারের দোকানে লাইন কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে। অনেক পরিবার মাংস, দুধ ও সবজির মতো খাবার গ্রহণই কমিয়ে দিয়েছে। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি যে আগের তুলনায় খানিকটা কমে এসেছে, তার সুফল তাঁরা নিজেদের জীবনে এখনো দেখতে পাচ্ছেন না।

মাংস বিক্রেতাদের একটি সংগঠনের সভাপতি মিগুয়েল শিয়ারিতি বলেন, পরিস্থিতি এখন সংকটজনক। পকেটের কথা বিবেচনায় নিয়ে এখন ভোক্তারা কেনাকাটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। তিনি আরও বলেন, প্রতি মাসেই ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। মাংস খাওয়ার পরিমাণ কম থাকবে বলেই মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

মাংস কম, পাস্তা বেশি

বুয়েনস এইরেস প্রদেশের গরুর খামারগুলো টের পাচ্ছে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছে।

লুইস মারচি একজন কৃষি প্রকৌশলী। ৪৮ বছর বয়স্ক এই ব্যক্তি তাঁর পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম, যাঁরা শস্য ও পশুসম্পদ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, মাংসের ভোগ কমে যাওয়া সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। গরুর মাংস খাওয়ার পরিমাণ খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। ভোক্তারা এখন সস্তা খাবার খাচ্ছেন, যেমন অন্য ধরনের মাংস কিংবা পাস্তা। তাঁর মতে, এর মূল কারণ মূল্যস্ফীতি ও খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।

আরেকজন খামারি ৫৩ বছর বয়স্ক গিয়ারমো ত্রামনতিনি বলেন, উৎপাদন খরচ বাড়ার পাশাপাশি গত বছরের খরা অনেক খামারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বড় খরচ না করার বিষয়ে খামারিরা চেষ্টা করছেন, না হলে তাঁদেরকে কর্মী ছাঁটাই করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আসলে গরুর মাংসের দাম খুব একটা বাড়েনি। মূল সমস্যা হলো, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে গেছে।

স্থানীয়ভাবে গরুর মাংসের বিক্রি কমে গেলেও এর রপ্তানি অবশ্য বেড়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে আবার গরুর মাংসের দাম কম। তাই খামারিদের খুব একটা লাভ হচ্ছে না। আর্জেন্টিনার গরুর মাংসের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ চীন। তবে যেসব মাংসের দাম কম, এমন মাংসই আমদানি করছে এশিয়ার দেশটি।

মাংস বিক্রেতাদের নেতা মিগুয়েল শিয়ারিতি বলেন, বিপুল পরিমাণ মাংস রপ্তানি করা হচ্ছে। কিন্তু এই রপ্তানি খাত এখন বেশ কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববাজারে মাংসের দাম বেশ অনেকটাই পড়ে গেছে।

সস্তার মাংস

বুয়েনস এইরেসে নিজের দোকানে ৪০ বছর ধরে কাজ করছেন জেরারদো তমসিন। ৬১ বছর বয়সী এই বিক্রেতা বলেন, মানুষ এখনো গরুর মাংস কিনতে আসছেন, তবে তাঁরা এসেই খোঁজেন সস্তা দামের মাংস। তিনি আরও বলেন, মানুষ কিনতে আসছেন। তবে মূল বিষয় হলো, তাঁরা মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা অন্য পণ্য খুঁজছেন। বিষয়টি অবশ্য দামের সঙ্গে সম্পর্কিত।

আরেকজন কসাই ৭৬ বছর বয়স্ক দারিও বারানদেগাই বলেন, মানুষ এখন সেই ধরনের গরুর মাংস কিনছেন, যা দামের দিক থেকে সবচেয়ে সস্তা। অথবা তাঁরা কম দামের অন্য মাংসের দিকে ঝুঁকছেন। তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে মুরগি ও শূকরের মাংস খাওয়ার পরিমাণ বেশ অনেকটাই বেড়েছে।

প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাসী একজন অর্থনীতিবিদ। নিজেকে তিনি অরাজক-পুঁজিবাদী হিসেবে পরিচয় দেন। আগের পেরোনিস্ট সরকারের আমলে গরুর মাংসের দাম না বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তিনি সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন।

ফাচুন্দো রিনাল ৪১ বছর বয়স্ক একজন শিক্ষক। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেশ অনেকটা বেড়েছে। আর দাম যখন বেশি বেড়ে যায়, তাঁরা তখন কিছুই কেনেন না। এর ফলে মাংস গ্রিল করার জায়গাগুলোতে মানুষ কম আসা–যাওয়া করছেন। আর সে কারণে কমে যাচ্ছে সামাজিক মেলামেশাও।

ফাচুন্দো রিনালের কথায়, ‘আমরা দেখছি মানুষ আগের তুলনায় কম বারবিকিউ করছে। যদিও এটি আর্জেন্টিনার সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।’