সরকারি আমানতকে শেয়ারে রূপান্তরের চেষ্টা পদ্মা ব্যাংকের
সমস্যায় থাকা পদ্মা ব্যাংক বড় আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পেরে তাদের এখন শেয়ার দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা পেয়েই ব্যাংকটি এই উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, পদ্মা ব্যাংক বড় অঙ্কের আমানত রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ার দেবে। ব্যাংকটিতে এমন আমানত রয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। আমানতকারীদের মধ্যে সবই সরকারি ব্যাংক, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি খাতের ট্রাস্ট তহবিল।
ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় সরকারি খাতের আমানতকারীদের শেয়ার দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপরই আমানতকারীদের প্রস্তাব পাঠানো শুরু করেছে ব্যাংকটি।
তবে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা ব্যাংক দেখভালে নিযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষক এই মতামত দিয়েছে, যা ব্যাংকটিকে রীতি মেনে জানানো হয়েছে। এখন তারা এই মতামত বাস্তবায়ন করতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন চাইবে। আমানতের টাকাকে শেয়ারে রূপান্তরের বিষয়ে ব্যাংকটিকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।’
এর আগে দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতকে শেয়ারে রূপান্তরের ঘটনা ঘটেনি। তবে ব্যক্তি আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর করে ইস্টার্ণ ব্যাংক পুনর্গঠন করা হয়েছিল। একই প্রক্রিয়ায় পদ্মা ব্যাংক পুনর্গঠন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকের একটি ছিল ফারমার্স ব্যাংক। ঋণে অনিয়মের কারণে সমস্যায় পড়লে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে এটি নাম পরিবর্তন করে হয় পদ্মা ব্যাংক। ২০২১ সালের ১৫ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক ডেল মরগান অ্যান্ড কোম্পানির সহায়তায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মূলধন সংগ্রহের আবেদন করে।
এরপর ব্যাংকটি আর্থিক বিবরণী ভালো দেখাতে নানা ছাড় চায়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো বিনিয়োগ আসেনি। তবে ব্যাংকটি সাধারণ আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিয়েছে, এখন আমানতও বাড়ছে। ছোট ঋণ কার্যক্রমও চালাচ্ছে।
শেয়ারে রূপ নেবে আমানত
বিদায়ী ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে পদ্মা ব্যাংকের আমানত ছিল ৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ২ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) এক হাজার কোটি টাকা এবং জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড ও জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের ৭৬০ কোটি টাকা। গত কয়েক বছরে ব্যাংকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮৭৪ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে।
এ ছাড়া বাকি এক হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি আমানত হচ্ছে জীবন বীমা করপোরেশন, সাধারণ বীমা করপোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, তিতাস গ্যাস, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ অবকাঠামো ফিন্যান্স ফান্ড লিমিটেড (বিআইএফএফএল), ইসলামিক ফাউন্ডেশন, নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের। এসব প্রতিষ্ঠান এখন জমা টাকাও ফেরত পাচ্ছে না, কেউ কেউ সুদও পাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকটি এসব আমানতকে অগ্রাধিকারমূলক শেয়ারে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে।
জীবন বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল খায়ের মোহাম্মদ হাফিজুল্লাহ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জমানো টাকা ফেরত চাই। এর পরিবর্তে শেয়ার দেওয়ার প্রস্তাব এলে পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেবে। এরপর সরকারের সম্মতির ওপর নির্ভর করবে শেয়ার নেওয়ার বিষয়টি।’
ব্যাংকটির পরিকল্পনা হলো, প্রথম দিকে নয়, দু-তিন বছর পর থেকে অগ্রাধিকারমূলক শেয়ারের বিপরীতে মুনাফা দেওয়া শুরু করবে। এভাবে কয়েক বছর চলার পর এসব শেয়ার সাধারণ শেয়ারে রূপান্তর হলে তারা ব্যাংক পরিচালনায় যুক্ত হবে। এদিকে সব সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ ট্রাস্ট তহবিলের টাকা কীভাবে শেয়ারে রূপান্তর হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তারেক রিয়াজ খান গতকাল সোমবার তাঁর নিজ কার্যালয়ে বসে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকে অগ্রাধিকারমূলক শেয়ারে রূপান্তরের নির্দেশনা দিয়েছে। এরপর আমাদের পরিচালনা পর্ষদে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবনা অনুমোদন হয়েছে। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের প্রস্তাব পাঠানো শুরু করেছি। তারা রাজি হলে তাদের আমানত শেয়ারে রূপান্তর হবে। এতে ব্যাংকের সূচকগুলো ভালো হয়ে যাবে। বড় আমানতকারীরা হবে ব্যাংকের বড় শেয়ারধারী।’
ছাড়েও উন্নতি নেই
২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়ার চার বছর না পেরোতেই সংকটে পড়ে ব্যাংকটি। পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় ২০১৭ সালে পদ ছাড়তে বাধ্য হন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ব্যাংকটির এমডি এ কে এম শামীমকেও অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন এই ব্যাংককে বাঁচাতে মূলধন সহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও আইসিবি। সেই সুবাদে ব্যাংকটির পরিচালনায় যুক্ত হন ওই চার ব্যাংক ও আইসিবির প্রতিনিধিরা। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে দি ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক।
২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর এক বিজ্ঞপ্তিতে পদ্মা ব্যাংক জানায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংক ডেল মরগান অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে ব্যাংকটি। অ্যান্ড কোম্পানির ৭০ কোটি ডলার (৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা) বিনিয়োগ আনতে মধ্যস্থতা করবে। ২ সেপ্টেম্বর ডেল মরগানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে পদ্মা ব্যাংক। অনুষ্ঠানে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও ডেলমর্গানের চেয়ারম্যান রব ডেলগাডো উপস্থিত ছিলেন।
এই বিনিয়োগ আনার স্বার্থে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটিকে বেশ কিছু নীতি ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ৯০০ কোটি টাকার বেশি লোকসানে থাকা ব্যাংকটিকে বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে এ লোকসান না দেখানোর সুযোগও দেওয়া হয়। লোকসানের বিপরীতে ‘ইনটেনজিবল অ্যাসেট বা অদৃশ্য সম্পদ’ সৃষ্টি করার সুযোগ দেওয়া হয়, যা পরের ১০ বছরের মুনাফা থেকে সমন্বয় করতে হবে। এ ছাড়া লোকসান সমন্বয়ের সময়সীমা পর্যন্ত ১০ বছর ব্যাংকটি শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সেই বিনিয়োগ আসেনি।
এর আগেও ব্যাংকটিকে বেশ কিছু নীতি ছাড় দেওয়া হয়। নগদ সংরক্ষণ বা সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট) ও বিধিবদ্ধ জমা বা এসএলআরের (স্ট্যাটিউটরি লিকুইডিটি রেশিও) অর্থ জমা রাখার বাধ্যবাধকতায় ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মওকুফ করা হয় দণ্ড-সুদ ও জরিমানা।
বিদায়ী ২০২৩ সালের শেষে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণই ৩ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। ফলে ঋণ থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে আমানতের সুদ পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ব্যাংকটি বড় লোকসানে চলছে। এখন আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর ও নতুন ঋণ দিয়ে ব্যবসা বাড়ানোতেই সমাধান খুঁজছে ব্যাংকটি।