শ্রমবাজারে বছরে ২৪ লাখ তরুণ আসেন, তবে চাকরি হয় না সবার

ভয়েস ফর রিফর্মের সংলাপ

প্রতিবছর দেশে বিপুলসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী শ্রমবাজারে আসছেন। কিন্তু তাঁদের কর্মসংস্থানের হার কম। এর প্রধান কারণ, দেশের অর্থনীতির বড় অংশ এখনো অপ্রাতিষ্ঠানিক। উচ্চশিক্ষিতরা উৎপাদন খাত ও কারখানা পর্যায়ে কাজ করতে চান না। ঢাকার বাইরে যাওয়ার আগ্রহও কম তাঁদের। বেসরকারি খাতের চেয়ে সরকারি চাকরিতে তাঁদের আগ্রহ বেশি। তা ছাড়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্নাতকধারীদের বেশির ভাগেরই বিষয়ভিত্তিক বাস্তবিক জ্ঞান অনেক কম থাকে। এ অবস্থায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমাতে হলে শ্রমবাজারে চাকরির প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্র বাড়াতে হবে।

নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ভয়েস ফর রিফর্ম আয়োজিত এক সংলাপের একটি অধিবেশনে বক্তারা এই পরামর্শ দেন। রাজধানীতে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আজ শনিবার ‘কর্মসংস্থান ও শিক্ষিত বেকার সংকট সমাধানে রাষ্ট্রের করণীয়’ শীর্ষক এ সংলাপের আয়োজন করা হয়।

সংলাপে বক্তারা বলেন, দেশে প্রতিবছর সব মিলিয়ে ২৪ লাখ তরুণ-তরুণী চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। এর মধ্যে ৫ থেকে ১০ লাখ দেশের বাইরে যান, যাঁদের অধিকাংশই অদক্ষ। দেশে বাকিদের সবার চাকরি হয় না। সে জন্য বিদেশে প্রশিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তাতে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান বলেন, ‘সবার জন্য চাকরির সুযোগ তৈরি করা সম্ভব নয়। আমাদের অধিকসংখ্যক উদ্যোক্তা তৈরির দিকেও নজর দিতে হবে। এ জন্য অন্যতম সম্ভাবনাময় হতে পারে কৃষি খাত। আধুনিকায়ন, যথাযথ প্রশিক্ষণ ও উচ্চমূল্যের কৃষিপণ্য উৎপাদনের সুযোগ থাকলে এই খাতে নতুন উদ্যোক্তারা আসবেন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রামভিত্তিক সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করা যেতে পারে। পাশাপাশি কাজের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যেন যোগসূত্র থাকে, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।’

ভয়েস ফর রিফর্ম প্ল্যাটফর্মের সহ-আহ্বায়ক ও বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর বলেন, বেকারত্বের সমস্যা যেকোনো দেশের অন্যতম মৌলিক সমস্যা। যে ছাত্র আন্দোলনের মুখে দেশে সরকারের পরিবর্তন হয়েছিল, সেটিরও সূত্রপাত হয়েছিল কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব ঘিরে। ফলে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা প্রয়োজন।

ফাহিম মাশরুর জানান, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে, যাঁরা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং এক মাস ধরে কাজপ্রত্যাশী ছিলেন, তাঁরা বেকার হিসেবে গণ্য হন। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এই নিয়ম অনুসারেই বেকারের হিসাব দিয়ে থাকে। বিবিএসের সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, দেশে বর্তমানে ৭ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে রয়েছেন। এর মধ্যে ২৬ লাখ মানুষ বেকার অবস্থায় আছেন।

ফাহিম মাশরুর বলেন, যত বেশি মানুষ শিক্ষিত হচ্ছেন, বেকারের সংখ্যা তত বাড়ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে থেকে টারশিয়ারি (উচ্চশিক্ষা) স্তরে বেকারত্বের হার দ্বিগুণের বেশি। গত এক দশকে দেশে শিক্ষিত বেকার তিন গুণ বেড়েছে। এর প্রধান কারণ আমাদের অর্থনীতিতে এখনো অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডই বেশি।

শ্রমবাজারে অপ্রাতিষ্ঠানিক চাকরির সুযোগ কমিয়ে আনতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন ইনোভেশন কনসাল্টিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবাইয়াৎ সরওয়ার। তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক সরকারগুলো তাদের স্বার্থের জন্য অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভর করে। কারণ, যেকোনো আন্দোলনে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে লোক জোগাড় করা সহজ হয়। তাই বর্তমান সরকারের অন্যতম সংস্কার কর্মসূচি হওয়া উচিত শ্রমবাজারকে যতটা সম্ভব প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা করা। জাতীয়ভাবে খাত ও বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য একটি শুমারি করারও পরামর্শ দেন তিনি।

ই-কমার্স উদ্যোক্তা ও আরটিএস এন্টারপ্রাইজের প্রতিষ্ঠাতা জীশান কিংশুক হক বলেন, ‘চাকরির বাজার সৃষ্টিতে একাডেমিয়া ও ইন্ডাস্ট্রি কোলাবরেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এটির ব্যাপকতা থাকলেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। চাকরিতে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সব ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট দেখা হয় না। বরং প্রার্থীর সফট ও হার্ড স্কিলসের ওপর জোর দেওয়া হয়।‘

সংলাপে আরও বক্তব্য দেন ইনোভেশন কনসাল্টিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রুবাইয়াৎ সরওয়ার।

শিক্ষিত বেকারত্ব লাঘবে ১০ প্রস্তাব

সংলাপে দেশে শিক্ষিত বেকারত্ব লাঘবে ১০টি প্রস্তাব তুলে ধরা হয়—১. শিক্ষিত বেকারত্ব–সংক্রান্ত সঠিক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ; ২. আগামী পাঁচ বছরের জন্য খাতভিত্তিক শ্রমবাজারের ডিমান্ড ফোরকাস্ট করে সে অনুসারে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিকনির্দেশনা প্রদান; ৩. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সব কলেজে বাধ্যতামূলক ভোকেশনাল কোর্স চালু। ৪. ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট নিয়োগ করে, তাহলে তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রথম বছরের বেতনের ৫০ শতাংশ রাষ্ট্র ভর্তুকি হিসেবে দেবে অথবা করসুবিধা দেবে। আবার কোম্পানিগুলোকে তাদের মুনাফার একটি অংশ এই খাতে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করতে হবে।

পঞ্চম প্রস্তাবটি হচ্ছে ইন্টার্নবিষয়ক। এ নিয়ে বলা হয়, সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স সম্পন্নের জন্য (সব বিষয়ে) বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ চালুর বিধান করা। ইন্টার্নশিপ ভাতা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব তহবিল থেকে দেবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা সরকার দেবে।

অন্য প্রস্তাবগুলো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক চাকরি ও উচ্চশিক্ষার হার প্রকাশ, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ছাড়াও অন্য বিদেশি ভাষা সেন্টার খোলা, ফ্রিল্যাসিং বা গিগ কর্মসংস্থান উদ্যোগকে এমএসএমই ব্যবসায় হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান ও এমএসএমই ব্যবসায়ীদের জন্য সহজ শর্ত ও কম সুদে ব্যাংকঋণ প্রদান, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ শেষে বা চাকরি নিয়ে বিদেশ গমনেচ্ছু স্নাতকদের ব্যাংকঋণ প্রদান এবং দেশে দক্ষতা ও কর্মসংস্থান নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য আলাদা এইচআরডি মন্ত্রণালয় গঠন।