দেশের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির যে তালিকা সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেছেন, তাঁদের অর্ধেকই বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহক। একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ব্যাংকটির মালিকানায় রয়েছে এবং বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের কারণে এই ব্যাংকটি সমস্যায় রয়েছে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকারের এক প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী কয়েক দিন আগে ২০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শীর্ষ ২০ খেলাপির ১০ জনই ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহক। এই ব্যাংকটি সিকদার গ্রুপের মালিকানাধীন। তারল্যসংকটের কারণে মাঝেমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক। এ জন্য জরিমানাও গুনেছে ব্যাংকটি।
ব্যাংকটির এমন পরিস্থিতিতে মালিকপক্ষের চাপে পদত্যাগ করেছিলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মেহমুদ হোসেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক মেহমুদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করার পর জানিয়েছে যে তিনি তার দায়িত্বে ফিরবেন।
সংসদে অর্থমন্ত্রী জানান, ২০ শীর্ষ খেলাপির মোট ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ঋণ তথ্য ব্যুরো (সিআইবি) ডেটাবেজে সংরক্ষিত (২০২২ সালের নভেম্বর মাসভিত্তিক) দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপির সংখ্যা ৭ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো গ্রুপের কোনো ঋণ খেলাপি হলে পুরো ঋণই খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়। সেই গ্রুপের ঋণ নেওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তাই পুরো ঋণকে খেলাপি ধরে হিসাব করা হয়েছে।
শীর্ষ ২০ খেলাপির মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ১০ খেলাপি গ্রাহক হলো সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, সাদ মুসা ফেব্রিকস, এস এ অয়েল রিফাইনারি, মাইশা প্রোপ্রাটি ডেভেলপমেন্ট, রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইল, সামান্নাজ সুপার অয়েল, মানহা প্রিকাস্ট টেকনোলজি, এহসান স্টিল রি-রোলিং ও সিদ্দিক ট্রেডার্স।
মন্ত্রীর দেওয়া তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খেলাপির তালিকায় এক নম্বরে থাকা সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ঋণ স্থিতি ১ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। এটি আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হকের প্রতিষ্ঠান। তাঁর আরেকটি প্রতিষ্ঠান মাইশা প্রোপ্রার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ঋণ ৬৮৬ কোটি টাকা। দুই প্রতিষ্ঠানই ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহক।
এরপরই ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহক ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের ঋণ ১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির আরেকজন খেলাপি গ্রাহক হলো সাদ মুসা ফেব্রিকস লিমিটেড, যাদের ঋণ ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। এর কর্ণধার মোহাম্মদ মোহসিন। তিনি নতুন প্রজন্মের সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মেরিডিয়ান ফাইন্যান্সের সাবেক পরিচালক। প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্ট চট্টগ্রামের রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলসের খেলাপি ঋণ ৭৭০ কোটি টাকা।
চট্টগ্রামের এস এ গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন আলমের এস এ অয়েল রিফাইনারি লিমিটেডের ঋণ ১ হাজার ১৭২ কোটি টাকা ও সামান্নাজ সুপার অয়েলের ১ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। দুটোই ন্যাশনাল ব্যাংকের গ্রাহক। শাহাবুদ্দিন আলম মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক।
এ ছাড়া ন্যাশনাল ব্যাংকের অপর তিন খেলাপি গ্রাহক হলেন মানহা প্রিকাস্ট টেকনোলজি, এহসান স্টিল রি-রোলিং লিমিটেড ও সিদ্দিকী ট্রেডার্স। এর মধ্যে মানহা প্রিকাস্ট টেকনোলজি লিমিটেডের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৪৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা, এহসান স্টিল রি-রোলিং লিমিটেডের ঋণ ৬২৪ কোটি ও সিদ্দিকী ট্রেডার্সের ঋণ ৬৭০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১১ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, এক বছর আগে যা ছিল ৪ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। এখন ব্যাংকটির ২৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ ঋণই খেলাপি।
অন্যদিকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ন্যাশনাল ব্যাংক নিট লোকসান করেছে ৩৫৭ কোটি টাকা। এর আগের বছরের একই সময়ে ১৩৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। আর ২০২০ সালে নিট মুনাফা করেছিল ৩৪৮ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ আদায়ের ন্যাশনাল ব্যাংকের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ব্যাংকটির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এ নিয়ে ব্যাংকটির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করলেও তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়নি বলে এর আগে জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক। ওই সময়ে তিনি বলেন, এমডি নিয়ম মেনে কাজে যোগ দেবেন।
তবে ব্যাংকটির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জানান, পর্ষদ এখনো তাঁকে কাজে ফেরানোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। একজন সাবেক এমডিকে ব্যাংকটিতে উপদেষ্টা ও ডিএমডিকে পদোন্নতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। আর খেলাপি ঋণ আদায় না করে মামলার মাধ্যমে তা কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বেসরকারি খাতের এই ব্যাংকটি কয়েক বছর ধরেই সংকটে রয়েছে। ব্যাংকটির মালিকানা এককভাবে সিকদার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর সংকট বেড়েছে বলে ব্যাংকখাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং একই সঙ্গে এমডিরা তাঁদের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ করতে পারছেন না।