এইচ–১বি ভিসা কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিতর্ক কেন, এটির ভবিষ্যৎ কী
অনেকটা গৃহযুদ্ধের মতো অবস্থা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক ব্যবসায়ীদের মধ্যে। অতি দক্ষ অভিবাসীদের জন্য চালু একটি ভিসাব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না, তা নিয়ে তাঁরা রীতিমতো বাগ্যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর অভিবাসনের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, তারই ধারাবাহিকতায় তাঁর সমর্থকদের মধ্যে এই যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েক দশক ধরেই এইচ-১বি ভিসা চালু রয়েছে। এই ভিসার সমর্থকেরা বলছেন, এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো হাজার হাজার মেধাবী কর্মী নিয়োগ করতে পারছে। তবে অভিবাসীবিরোধীরা মনে করেন, বেশি বেতন ও সুবিধা দিয়ে আমেরিকানদের কাজে লাগানোর বদলে এই কর্মসূচির মাধ্যমে আসলে বিদেশি কর্মীদের শোষণ করা হচ্ছে।
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই কর্মসূচির একজন সমর্থন টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইলন মাস্ক। তিনি বলেছেন, ‘মেধাবী অনেক মানুষের সঙ্গে আমিও যে আমেরিকায় তার একটি কারণ হলো এইচ-১বি। এই মানুষগুলো স্পেসএক্স, টেসলা এবং আরও শত শত কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁরাই আমেরিকাকে শক্তিশালী বানিয়েছেন।’
ইলন মাস্ক আরও বলেন, ‘এই ইস্যুতে আমি যুদ্ধে যাব, এমন যুদ্ধ যা আপনি হয়তো ধারণাও করতে পারবেন না।’
এইচ-১বি ভিসা কী
যুক্তরাষ্ট্রের নিয়োগকর্তারা এইচ-১বি ভিসার আওতায় সাময়িক সময়ের জন্য বিদেশি কর্মীদের বিশেষ ধরনের কাজ দিতে পারেন। তাঁরা এমন কাজ করবেন, যে কাজের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন আমেরিকানদের খুঁজে পাওয়া যায় না। আবেদনকারীকে কমপক্ষে স্নাতক ডিগ্রি বা বিশেষ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। এই ভিসা নিয়ে একজন সর্বোচ্চ ছয় বছর আমেরিকায় কাজ করতে পারেন।
রয়টার্স জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র ২ লাখ ৬৫ হাজার ৭৭৭টি এইচ-১বি ভিসা দিয়েছিল। এই ভিসার ৭৮ শতাংশ পেয়েছিল ভারতীয়রা। সে কারণে দেশটি এই ভিসা কর্মসূচি বহাল রাখার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই ভিসার আওতায় কর্মী নিয়োগ করেছে। বিশেষ করে কম্পিউটার প্রোগ্রামার ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা এসব কোম্পানির আগ্রহের জায়গা। তাদের যুক্তি হলো, এ ধরনের কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যথেষ্ট সংখ্যক দক্ষ কর্মী পাওয়া যায় না।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, চলতি বছরে এইচ-১বি ভিসা কর্মসূচি থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে অ্যামাজন। অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর আমেরিকান পলিসির তথ্যানুসারে, কোম্পানিটি এই ভিসা কর্মসূচিতে আসা ৩ হাজার ৮৭১ জনকে চাকরি দিয়েছে। এইচ-১বি কর্মসূচির সুবিধা পাওয়া শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে আরও রয়েছে গুগল, মেটা, অ্যাপল এবং আইবিএম।
যুক্তরাষ্ট্র বিদেশি কর্মী নিয়োগে আরও ভিসা কর্মসূচি রয়েছে। যেমন এইচ-২এ ভিসা দেওয়া হয় কৃষিশ্রমিকদের এবং এইচ-২বি ভিসা দেওয়া হয় মৌসুমি ও স্বল্পমেয়াদি কর্মীদের।
এইচ-১বি ভিসা কর্মসূচির শুরু কীভাবে
গবেষণা প্রতিষ্ঠান মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো মুজাফ্ফর চিশতি বলেন, এই ভিসার গোড়া রয়েছে ১৯৫২ সালের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টে। এই আইনের বলে জাতিভিত্তিক অভিবাসন বন্ধ করে কাজ ও দক্ষতাভিত্তিক অভিবাসনের নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট পাসের মাধ্যমে এইচ-১এ এবং এইচ-১বি ভিসা কর্মসূচি চালু করেন। এইচ-১এ কর্মসূচির আওতায় নার্স নিয়োগ করা হয়েছে এবং এই ব্যবস্থার মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। তবে তিন দশকের বেশি সময় ধরে এইচ-১বি কর্মসূচি চালু রয়েছে এবং এর আওতায় বিদেশে জন্মগ্রহণকারী কলেজের ডিগ্রিধারী কর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
মুজাফ্ফর চিশতি বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে চীন ও ভারত থেকে প্রচুর কর্মী যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন এবং তাঁরাই প্রযুক্তিশিল্পকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলায় অবদান রেখেছেন।
এখন কেন আপত্তি
সম্প্রতি এইচ-১বি কর্মসূচি নিয়ে ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। এ সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে ভারতে জন্মগ্রহণ করা বিনিয়োগকারী শ্রীরাম কৃষ্ণানকে নিয়োগ করার জন্য উগ্র ডানপন্থী অ্যাকটিভিস্ট লরা লুমার সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর সমালোচনা করেন।
লুমারের অভিযোগ, বছরে কতগুলো গ্রিন কার্ড দেওয়া হবে, সেই সংখ্যার ওপর যে ঊর্ধ্বসীমা আরোপ করা আছে, তার কিছুটা তুলে নেওয়ার বিষয়টি কৃষ্ণান সমর্থন করছেন। এ ছাড়া তিনি দক্ষ বিদেশি কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া সহজ করার পক্ষে। এক্সে লুমার লেখেন, এই নীতি ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ‘সরাসরি বিরোধী’।
ট্রাম্পের সাবেক একজন উপদেষ্টা স্টিভেন কে ব্যানন মনে করেন, এইচ-১বি ভিসাব্যবস্থা কোম্পানিগুলোকে সস্তার বিদেশি শ্রমিক শোষণ করার পথ খুলে দিয়েছে, বিশেষ করে যখন মার্কিন নাগরিকেরা কাজ পাচ্ছেন না।
ইলন মাস্ক এই কর্মসূচি সংস্কার করার যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা নাকচ করে ব্যানন বলেন, ‘সংস্কারের কোনো জায়গা নেই। সংস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা চাই এটা বাতিল হোক। আমাদের দাবি এটা বাতিল করা হোক।’
ট্রাম্প এখন কী বলছেন
ডোনাল্ড ট্রাম্প আগে এই কর্মসূচির বিপক্ষে ছিলেন। তবে তিনি এখন এইচ-১বি সমর্থনকারী প্রযুক্তি জায়ান্টদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তিনি এইচ-১বি কর্মসূচিকে সমর্থন করেন।
নিউইয়র্ক পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি সব সময় এই ভিসা কর্মসূচি পছন্দ করেছি। আমি সব সময় এর পক্ষে ছিলাম। সে কারণেই এই ভিসা এখনো আছে। আমার সম্পত্তিতে অনেক এইচ-১বি ভিসাধারী আছেন। আমি এই ভিসায় বিশ্বাস করি। আমি নিজেও এটা অনেকবার ব্যবহার করেছি। এটা দারুণ এক কর্মসূচি।’