তিন মাসের মধ্যে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ

পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এবার এলসি মার্জিন ছাড়াই নিত্যপণ্য আমদানির সিদ্ধান্ত।

গ্রাম ও শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশের বেশিফাইল ছবি

সার্বিক মূল্যস্ফীতি আবার দুই অঙ্কের ঘর ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গতকাল যে হিসাব প্রকাশ করেছে, সে অনুযায়ী অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত তিন মাসে, অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে, দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে। কয়েক দফায় নীতি সুদহার বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সে কারণে ঊর্ধ্বমুখী এই মূল্যস্ফীতি পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিবিএসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান হাতে নিয়ে অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল বৈঠক করেন সচিবালয়ে, যেখানে পণ্যের আমদানি বাড়াতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার, শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা প্রমুখ।

বিবিএসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মূলত অক্টোবর মাসের চড়া বাজার পরিস্থিতিকেই প্রতিফলিত করেছে। এই মাসে প্রায় সব খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ে। এক ডজন ডিম কিনতেই একজন ক্রেতাকে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা খরচ করতে হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে সবজির দামও দৃশ্যত নিম্নবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে ছিল।

মূল্যস্ফীতির হিসাব এত দিন নিয়ন্ত্রিত ছিল। কৃত্রিমভাবে দেওয়া হতো হিসাব। বর্তমান সরকার মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হিসাব দিচ্ছে, এটা বলা যায়।
আহসান এইচ মনসুর, গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

বৈঠক শেষে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং করতে গভর্নরকে দায়িত্ব দেন অর্থ উপদেষ্টা। গভর্নর বলেন, নিত্যপণ্য আমদানিতে সাময়িকভাবে ঋণপত্রের (এলসি) মার্জিন তুলে দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকের একক গ্রাহকের বিদ্যমান ঋণসীমা। এ ঋণসীমা ব্যাংকের কাছে ‘সিঙ্গেল বরোয়ার লিমিট’ হিসেবে পরিচিত।

গভর্নর জানান, নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলসি মার্জিন ছাড়াই নিত্যপণ্য আমদানি করা যাবে। তবে এটা শুধু রোজাকে সামনে রেখে সাময়িক সময়ের জন্য। আমদানি করা যাবে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, গম ইত্যাদি পণ্য। নিত্যপণ্যের পাশাপাশি সারও আমদানি করা যাবে এলসি মার্জিন ছাড়া। ব্যবসায়ীরা ব্যাংকে কোনো অর্থ জমা দেওয়া ছাড়াই এলসি খুলতে পারবেন। অর্থাৎ ব্যাংক যদি তার গ্রাহকের ব্যাপারে আস্থাশীল থাকে, তাহলে বাকিতেই এলসি খোলা যাবে।

ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় গ্রাহকদের জন্য ‘সিঙ্গেল বরোয়ার লিমিট’ প্রযোজ্য রয়েছে। অর্থাৎ একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কোনো ব্যাংক থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি ঋণ পায় না। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে এ সীমাবদ্ধতা যখন উঠে যাবে, তখন বড় আমদানিকারকেরা প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংকঋণ পাবেন। এ সুবিধাও খাদ্য ও নিত্যপণ্য এবং সার আমদানির ক্ষেত্রে। আগামী সপ্তাহে এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতির হিসাব এত দিন নিয়ন্ত্রিত ছিল। কৃত্রিমভাবে দেওয়া হতো হিসাব। বর্তমান সরকার মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হিসাব দিচ্ছে, এটা বলা যায়। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি ও মূল্যস্তর এক বিষয় নয়। অনেক সময় মূল্যস্ফীতি কমলেও পণ্যমূল্য বেড়ে যেতে পারে। তবে আমরা আশাবাদী যে আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমছে।’

সরবরাহব্যবস্থা ভালোর জন্য

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, সরবরাহব্যবস্থা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। সরবরাহ বাড়াতে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক শূন্য করে দেওয়া হয়েছে। একক গ্রাহক ঋণসীমা বড় আমদানিকারকদের জন্য একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন তিনি। কোন কোন কোম্পানির জন্য আমদানিতে ঋণসীমা উঠিয়ে দেওয়া হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘পাঁচ থেকে ছয়টি বড় কোম্পানি মূলত বাজারে চিনি, ভোজ্যতেল, গমের সরবরাহ ও নিয়ন্ত্রণ করে। এসব কোম্পানিকে সব সময় এ কাজে থাকতে হবে। তাদের দাম নির্ধারণের বিষয়টি আমরা তদারক করব। দেখব কেউ যেন একচেটিয়া কারবার করতে না পারে।’

চালের দাম ও বৈদেশিক মুদ্রা প্রসঙ্গ

গভর্নর বলেন, চালের যে বর্তমান দাম, গত বছর তা আরও ৫ থেকে ৬ টাকা বেশি ছিল। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেই। চাল আমদানিতে সম্প্রতি সব ধরনের শুল্ক কমিয়ে শূন্য করে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বৈদেশিক মুদ্রা প্রসঙ্গে আহসান মনসুর বলেন, ‘আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার কোনো সমস্যা নেই। যে কেউ এলসি খুলতে পারবেন।’