নতুন করে ব্যবসায়ে নামতে চায় এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনি-২০০০
এক যুগ বন্ধ থাকার পর নতুন করে ব্যবসায়ে ফেরার ঘোষণা দিয়েছে বিতর্কিত বহু স্তর বিপণন (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে কোম্পানিটি। তবে টাকা ফেরত দেওয়া হবে ব্যবসা করে, সম্পদ বিক্রি করে নয়।
রাজধানীর কাকরাইলে আইডিইবি মিলনায়তনে আজ রোববার অনুষ্ঠিত কোম্পানিটির ‘২৫ বছরে পদার্পণ’ অনুষ্ঠানে এমন ঘোষণা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে ১৯ সদস্যের পর্ষদের বেশির ভাগই উপস্থিত ছিলেন। পর্ষদে ১২ জন হচ্ছেন শেয়ারহোল্ডার পরিচালক।
স্বতন্ত্র পরিচালক আহমেদ মুশফেক আনামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আদালতের নিয়োগ করা ডেসটিনি ২০০০–এর চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া। গত বছরের ২৩ মে আদালত তাঁকে এ পদে নিয়োগ দেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সাংবাদিক এম এ আজিজ।
২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে ডেসটিনি ২০০০–এর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ২০২৩ সালের ১৪ জুন তিনি পদত্যাগ করেন। আদালত একই বছরের ২৫ জুলাই কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ ফখরুদ্দিন আহমেদকে। গত বছরের মে মাসে তিনিও পদত্যাগ করেন।
২০০১ সালের ৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে কোম্পানিটি প্রথম এক যুগ সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করে। বন্ধ থাকার কারণে পরের এক যুগ ব্যবসা করতে পারেনি। দেশজুড়ে তাদের ৪৫ লাখ গ্রাহক ছিলেন। ডেসটিনি ২০০০–এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীনের অনুপস্থিতিতে তাঁর আত্মীয় আশরাফুল আমীন কোম্পানিটিকে গোছাচ্ছেন।
অনুষ্ঠানে এসব কথা উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, যত টাকা আত্মসাৎ হয়েছে বলে বলা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ রয়েছে ডেসটিনির। তাই এত বছরেও গ্রাহকেরা হাল ছাড়েননি। ব্যবসা করবেন বলে তাঁরা নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছেন। অনেক বছর কারাগারে থাকা কোম্পানি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন ও এমডি রফিকুল আমীনের মুক্তিও দাবি করেন তাঁরা। বক্তারা বলেন, ৫ আগস্টের পর অনেক মামলা শেষ হয়ে গেলেও রফিকুল আমীনের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা এখনো রয়ে গেছে।
প্রধান অতিথি প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া অনুষ্ঠানে সশরীর উপস্থিত ছিলেন না। অনলাইনে যুক্ত হয়ে তিনি ডেসটিনি ২০০০-এর নবযাত্রাকে সফল করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যবসা শুরু করার দ্বারপ্রান্তে। শিগগিরই আমাদের হতাশা দূর হয়ে যাবে।’
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাজধানীর কলাবাগান থানায় ২০১২ সালের ৩১ জুলাই মামলা দুটি দায়ের করে। একটি মামলায় ১৯ জনের এবং অপর মামলায় ৪৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং বেআইনিভাবে অর্থ পাচারের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় রফিকুল আমীনকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া ডেসটিনি ২০০০-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হারুন অর রশীদসহ ৪৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
অভিযোগ হয়েছে, ডেসটিনি গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তারা এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডেসটিনি ট্রি প্ল্যান্টেশনের গাছ বিক্রির নামে ২ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া ঋণপত্র (এলসি) ব্যবহার করে তাঁরা ৫৬ কোটি ১৯ লাখ টাকার পাশাপাশি ২ লাখ ৬ হাজার মার্কিন ডলার পাচার করেন। গত ২৮ নভেম্বর ট্রি প্ল্যান্টেশন–সংক্রান্ত মামলার রায় হওয়ার দিন ধার্য থাকলেও আদালত ১৫ জানুয়ারি নতুন তারিখ ধার্য করেছেন।
অনুষ্ঠানের সভাপতি আহমেদ মুশফেক আনাম বলেন, ‘ডেসটিনির বড় সম্পদ ৪৫ লাখ প্রশিক্ষিত গ্রাহক। অন্য সম্পদ কেনা যায়, এ সম্পদ তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যেক গ্রাহক একজন করে উদ্যোক্তা।’ আইন মেনে ব্যবসা করা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিশেষ অতিথি এম এ আজিজ বলেন, ডেসটিনি ২০০০ এমন এক বিরল প্রতিষ্ঠান, যার বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের কোনো অভিযোগ নেই।
ডেসটিনি ২০০০–এর নবযাত্রা সম্পর্কে অনুষ্ঠানে পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল জামাল বলেন, একটা দামি গাড়ি ১২ বছর চলেছিল। পরের ১২ বছর ছিল গ্যারেজে। একটু সমস্যা হলেও এ গাড়ি আর থামবে না।
আশরাফুল আমীন বলেন, ‘ঘোষণা দিচ্ছি বিনিয়োগকারীরা টাকা ফেরত পাবেন, তবে সম্পদ বিক্রি করে নয়। আগামী রমজানে সারা দেশে আমরা অলাভজনক ফুড ব্যাংক স্থাপন করতে চাই।’
ব্যবসা করে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি অনুষ্ঠানে দেওয়া হলেও উপস্থিত কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা আগের পাওনা ফেরত চান, তারপর ব্যবসা শুরু করতে চান।
আদালতের নির্দেশে ২০১৩ সাল থেকেই ডেসটিনির নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির দায়িত্ব পুলিশের। অর্থাৎ ডেসটিনির সম্পদের রিসিভার বা তত্ত্বাবধায়ক পুলিশ। রাজধানীতে থাকা ডেসটিনির সম্পদ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এবং রাজধানীর বাইরের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার (এসপি। ডেসটিনির সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে ডিএমপির একটি কমিটি রয়েছে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও ডেসটিনি-২০০০ লি. নামের কোম্পানির ক্রোককৃত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও তদারকি–সংক্রান্ত আহ্বায়ক কমিটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিরা কথিত প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নিজেদের নামেও বিপুল সম্পদ কিনেছেন। এগুলোর মধ্যে বাড়ি, গাড়ি, সিনেমা হল ছাড়াও রয়েছে পাটকল, হিমাগার, টেলিভিশন চ্যানেল ও ধানি জমি।