চালের দামও বেঁধে দেবে সরকার
সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা কার্যকর করা যায়নি। এবার সারা দেশে চালের দাম বেঁধে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম গতকাল রোববার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা-বিষয়ক টাস্কফোর্সের বৈঠক শেষে চালের দাম বেঁধে দেওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানান।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরু চাল, চিকন চাল ও মোটা চাল—এ পদ্ধতি থেকে বের হয়ে এসে জাতভিত্তিক চালের নাম ও দাম ঠিক করা হবে। এ জন্য ইতিমধ্যে উৎপাদক, মিলমালিক, পাইকারি এবং খুচরা পর্যায়ে চাল বিক্রির একটা রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য—এ তিন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজটি করেছে। আগামী পয়লা বৈশাখ, অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল থেকে চালের নতুন দাম কার্যকর হবে।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম গতকাল রোববার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা-বিষয়ক টাস্কফোর্সের বৈঠক শেষে চালের দাম বেঁধে দেওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানান।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এতে ৬টি ধরনের আওতায় ১৫ জাতের চালের দাম ঠিক করা হয়। নির্ধারিত দর প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ৪৮ টাকা, সর্বোচ্চ ৫৫ টাকা ৫৭ পয়সা।
অবশ্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নতুন নির্ধারিত সর্বনিম্ন দামের চেয়ে তিনটি বিভাগীয় শহরে কম দরে চাল বিক্রি করা হচ্ছে—রাজশাহীতে প্রতি কেজি ৪৫ টাকা এবং রংপুর ও সিলেটে ৪৬ টাকা।
সারা দেশের জন্য একই দর নির্ধারণ নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, উৎপাদন এলাকা এবং গ্রামে ব্যয় কম, দামও কিছুটা কমে পাওয়া যায়। বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সব জায়গায় একই দর নির্ধারণ করা হলে যেখানে কম দামে পাওয়া যায়, সেখানেও বাড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কা থাকে।
দেশে চার বছর ধরেই চালের দাম চড়া। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, রাজধানীর বাজারে এখন প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকায়। মাঝারি চাল ৫৫-৫৮ ও সরু চাল ৬৫-৭৬ টাকায় কিনতে পারছেন ক্রেতারা। টিসিবির হিসাবে, ২০২০ সালের শুরুতে মোটা চালের সর্বনিম্ন দর ছিল ৩০ টাকা। সরু চাল পাওয়া যেত সর্বনিম্ন ৪৫ টাকায়। গত এক মাসে চালের দাম ৩ থেকে ৮ শতাংশ বেড়েছে বলেও জানায় টিসিবি।
দেশে চার বছর ধরেই চালের দাম চড়া। টিসিবির হিসাবে, রাজধানীর বাজারে এখন প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫২ টাকায়। মাঝারি চাল ৫৫-৫৮ ও সরু চাল ৬৫-৭৬ টাকায় কিনতে পারছেন ক্রেতারা।
বাজারে চালের দাম বাড়লে তা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে বেশি ভূমিকা রাখে। কারণ, মূল্যস্ফীতির হিসাবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে চালের দাম। দেশে দীর্ঘ সময় ধরে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি।
এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষণা করা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। নতুন সরকারের মন্ত্রীরাও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দেওয়ার কথা বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমাতে ব্যাংকঋণের সুদের হারের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেছে। ফলে সুদের হার বেড়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার এখনো উচ্চই রয়ে গেছে। গত ফেব্রুয়ারিতেও মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৯ শতাংশের বেশি।
এমন পরিস্থিতি গতকাল দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা-বিষয়ক টাস্কফোর্সের বৈঠক হয়। এতে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) চেয়ারম্যান আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে বিটিটিসির পক্ষ থেকে সংস্থাটির উপপ্রধান মো. মাহমুদুল হাসান বাজার পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তাঁর উপস্থাপনায় বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম যে হারে কমেছে, আটার দাম সে তুলনায় কমেনি। রয়টার্সের তথ্যের ভিত্তিতে বিটিটিসি বৈঠকে জানায়, এক বছর আগে প্রতি টন গমের আমদানি মূল্য ছিল ৩৩৪ মার্কিন ডলার। গত ২৯ মার্চ প্রতি টন গমের আমদানি মূল্য ছিল ২৫০ ডলার।
অবশ্য বিটিটিসি আরও জানায়, কিছু কিছু পণ্যের দাম রমজান মাসের শুরুর দিকে যা ছিল, তার চেয়ে এখন কমেছে। বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম রমজানে স্থানীয় বাজারে নিত্যপণ্যের যে দাম ছিল, ধারাবাহিকভাবে তা কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারের যে অবস্থাই হোক আগামী কোরবানির ঈদ পর্যন্ত পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো সমস্যা হবে না। চিনি নিয়েও কোনো সমস্যা নেই।
কৃষিজ পণ্যের বাজারদর অনেকটা যৌক্তিক পর্যায়ে চলে এসেছে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভারত থেকে পেঁয়াজ আসছে। ১ হাজার ৬৫০ টন পেঁয়াজ গতকাল রাতেই দেশে আসার কথা।
বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করলেও টিসিবির তথ্য বলছে, গত বছরের এই সময়ের তুলনায় বিভিন্ন দাম অনেকটাই বেশি। যেমন বাজারে পেঁয়াজের দাম সাম্প্রতিক কালে কমেছে। বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়। যদিও গত বছর এই সময়ে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০-৪০ টাকা। আলুর দাম গত বছরের চেয়ে এখন ৮১ শতাংশ বেশি।
চালের দাম হবে জাতভিত্তিক
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে চালের নির্ধারিত দরের একটি তালিকা পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, সরকার মূলত বোরো ও আমন মৌসুমে উৎপাদিত মোটা ও মাঝারি চালের দাম নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। এই দুই মৌসুমেই দেশে সবচেয়ে বেশি চাল পাওয়া যায়। আউশে কম।
দাম নির্ধারণ হবে জাতভিত্তিক। যেমন বোরো মৌসুমে উৎপাদিত হাইব্রিড হিরা, এসএলএইচ ৮ ব্রি হাইব্রিড জাতের চালের দাম হবে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৪৮ টাকা ১ পয়সা। মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে উৎপাদনমূল্য, মিলমালিক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
মিলমালিকেরা এখন নিজেদের ব্র্যান্ডের নামে বিভিন্ন জাতের চাল বাজারজাত করেন। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন জাতের চালকে কিছুটা ছেঁটে মিনিকেট নামে বিক্রি করা হয়। বাজারে জনপ্রিয় সরু এই চালের দামও বেশি। বিভিন্ন কোম্পানি নানা মোড়কে এই চাল বিক্রি করে। তারা দাম বাড়িয়ে দেয়। তাই আগে থেকেই এসব নাম বাদ দিয়ে জাতভিত্তিক নামে চাল বিক্রির উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছিল।
প্রশ্ন হলো, যেসব চালের দাম নির্ধারণ করা হবে, তার মধ্যে সরু চাল থাকবে কি না। এখন পর্যন্ত যে ১৫ জাতের চালের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে নাজিরশাইল, জিরাশাইলসহ বিভিন্ন সরু চাল নেই।
সরু চাল তালিকায় থাকবে কি না, তা নিয়ে কৃষিসচিব ওয়াহিদা আক্তারের কাছে গত রাতে মুঠোফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে সময়মতো চমকটা দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই।’
চালের দাম নির্ধারণ নিয়ে পুরো বিষয়টি বোঝার জন্য গতকাল বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে ৩ এপ্রিল আরেকটি বৈঠক রয়েছে। সেখান থেকে সবকিছু উঠে আসবে বলে তিনি আশা করছেন।
নির্ধারিত দর মানে না কেউ
সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময়ে মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় কিছু কিছু পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চালকল মালিকদের বৈঠকে চালের দাম বেঁধে দেওয়া হয়। যদিও তা কার্যকর করা যায়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিয়মিত বিরতিতে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম ঠিক করে দেয়। তবে বাজার নির্ভর করে বিশ্ববাজার পরিস্থিতির ওপর।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গত সেপ্টেম্বরে আলু, ডিম ও দেশি পেঁয়াজের দাম ঠিক করে দিয়েছিল। এর কোনোটিই বাজারে কার্যকর হয়নি। চলতি রমজান উপলক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ২৯টি পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল। তা কার্যকর করানোর তেমন কোনো চেষ্টা দেখা যায়নি; বরং বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী গতকাল বলেন, ২৯টি পণ্যের যৌক্তিক মূল্য প্রকাশ করায় অনেক বিতর্কের শিকার হতে হয়েছে।
বাংলাদেশে এখন চাল আমদানি নিষিদ্ধ। আমদানি করতে হলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। চাল উৎপাদন ও চাহিদার পরিসংখ্যান নিয়েও প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের গবেষণায় দেখা গেছে, চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করে মূলত বড় চালকলগুলো। কিন্তু তাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) প্রফেসরিয়াল ফেলো এবং সাবেক গবেষণা পরিচালক এম আসাদুজ্জামান চালের দাম নির্ধারণের বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, যথাযথ বাজার ব্যবস্থাপনা বাদ দিয়ে চাল সরু না মোটা এবং চালকে কী নামে ডাকা হবে—এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনো লাভ হবে না। কোন পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি আছে, কোন পণ্য আমদানিতে এখন জোর দিতে হবে বা আগামী তিন মাস পর কোন পণ্যের বাজার পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে—এসব নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো পূর্বাভাস আছে? তা নেই।
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলব, প্রকৃত কাজের পরিবর্তে তারা অপ্রয়োজনীয় কাজে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।’