বিদেশে অর্থ পাচার: ফেরেনি এক টাকাও, কারণ ‘কেউ পাচারকারীর তালিকায়’ নাম ওঠাননি

প্রতীকী ছবি

চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর সবচেয়ে বেশি আলোচনার বিষয় ছিল বিনা প্রশ্নে বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনতে দেওয়া সুযোগ। তখন এ নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়। অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, কেউ এ সুযোগ নেবে না। তাঁদের কথা সত্য হতে চলেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে কেউ ৭ শতাংশ কর দিয়ে টাকা দেশে আনেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চেয়ে এনবিআর এমন তথ্য পেয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেটে বলা হয়, গত বছরের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এই সুযোগ নেওয়া যাবে। ৭ শতাংশ কর দিয়ে বাংলাদেশের বাইরে যেকোনো রূপে গচ্ছিত অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধভাবে দেশে এনে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করা যাবে।

এই সুযোগ নিলে এনবিআরসহ অন্য কোনো সংস্থা এই বিষয়ে প্রশ্ন করবে না বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।

নীতিনির্ধারকেরা তখন আশা করেছিলেন যে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অনেকেই টাকা দেশে আনবেন। কিন্তু প্রথম ১০ মাসের এমন করদাতার দেখা মেলেনি। পাচারকারীর খাতায় নাম ওঠাতে চাননি কেউ।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন এই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তখনই বলেছিলাম কেউ এই সুযোগ নেবে না। এক টাকাও আসবে না। সেটাই এখন হয়েছে।’

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘এ ধরনের সুযোগ দেওয়ার কোনো অর্থনৈতিক যুক্তি নেই, নৈতিকভাবেও সমর্থনযোগ্য নয়। এতে সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবেও গ্রহণযোগ্য নয়। জনগণের ধারণা, অনৈতিকভাবে আয় করা অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। যে টাকা পাচার করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেছেন, সেই টাকা কেন আবার আনবেন?’

মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, যেহেতু এই সুযোগটি বাস্তবে কোনো কাজে আসেনি, তাই আইনের প্রয়োগ বাড়িয়ে বিদেশ টাকা পাচার রোধ করা উচিত।

কেন পাচার করা টাকা আসেনি

বাজেটে শর্ত দেওয়া হয়েছিল যে সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে দেশের বাইরে পাচার করা অর্থ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা যাবে। তবে পাচারকারীরা এই সুযোগ না নিয়ে রেমিট্যান্স হিসেবে অর্থ দেশে এনে লাভবান হতে পারেন।

এ খাতের বিশ্লেষকেরা বলেন, কোন পাচারকারী যদি মনে করেন যে তিনি দেশে টাকা আনবেন, তাহলে তিনি রেমিট্যান্স হিসেবে ওই অর্থ দেশে পাঠাতে পারেন। এতে কর তো দিতেই হবে না, বরং আড়াই শতাংশ প্রণোদনা পাবেন। সহজ করে বলা যায়, পাচার করা ১ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ দেশে আনলে ৭ লাখ টাকা কর দিতে হবে। আর ওই ব্যক্তি যদি ১ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ রেমিট্যান্স হিসেব পাঠালে ১ কোটি আড়াই লাখ টাকা পাবেন। দুটি ক্ষেত্রেই কোনো প্রশ্ন করবে না দেশের কোনো সংস্থা।

বলা হয়েছে, পাচার করা অর্থ আনলে সরকারের কোনো সংস্থাই প্রশ্ন করবে না। কিন্তু ৩০ জুনের পর (মেয়াদ শেষে) প্রশ্ন করা হবে কি না, তা পরিষ্কার করা হয়নি। এ কারণে অনেকে অর্থ আনতে উৎসাহিত হবেন না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন। এ ছাড়া ফেরত আনার তালিকা প্রকাশ হয়ে গেলেও সামাজিক মর্যাদাহানির শঙ্কা আছে তাদের।

এনবিআরের আয়কর বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কেউ পাচারকারীর তালিকায় নাম লেখাতে চান না। তাই এ সুযোগ নেননি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমন কোনো তথ্য মেলেনি।

এই পর্যন্ত বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনতে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৭ দেশ এই সুযোগ দিয়েছে। শুধু ইন্দোনেশিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশ এ ক্ষেত্রে তেমন একটা সফল হয়নি।