আইএমএফ জানতে চায়, খেলাপি ঋণ বাড়ছে কেন

জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়, যা গত বছরের চেয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা বেশি।

খেলাপি ঋণ
প্রতীকী ছবি

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে কেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে তা জানতে চেয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আইএমএফকে যে জবাব দিয়েছে, তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি সংস্থাটি।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলেছে, প্রকৃত চিত্র তুলে আনার জন্য খেলাপি ঋণের হিসাব এখন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী করা হয়। এত দিন যেভাবে হিসাব করা হতো, তাতে বাস্তবে খেলাপি ঋণ থাকলেও হিসাবের বাইরে থেকে যেত। তবে অসন্তোষ প্রকাশ করেও আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছে, সব সময় যেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ীই খেলাপি ঋণের হিসাব করা হয়।

সচিবালয়ে গতকাল রোববার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে আইএমএফের সফররত প্রতিনিধিদল বৈঠক করেছে। বৈঠকে আইএমএফের নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। আর সরকারের পক্ষে নেতৃত্ব দেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। এ সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারাসহ সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আফজাল করিম উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি ঋণসহ রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক চিত্র, ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট, ব্যাংকগুলোকে দেওয়া পুনর্মূলধন, বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের চিত্র এবং ব্যাংক তথা আর্থিক খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত আইন প্রণয়নের হালনাগাদ চিত্র তুলে ধরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক শেষে সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর বক্তব্য জানতে কার্যালয়ে গেলে তাঁর একান্ত সচিব শিহাব উদ্দিন আহমেদ জানান, সচিব তাঁকে বলেছেন যে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্তিশালী হওয়া এবং খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া ছাড়া অবস্থার উন্নতি হবে না, আইএমএফ বললেও কোনো লাভ হবে না।
সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

সূত্রগুলো জানায়, বৈঠকে জানানো হয় যে গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় ৩৫ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে ২০২২ সালের জুনের তুলনায় ২০২৩ সালের জুনে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণই বেড়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনে ছয় ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল ৫৫ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা, যা এ বছরের জুনে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো হচ্ছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল।

খেলাপি ঋণ
প্রতীকী ছবি

আইএমএফের স্টাফ মিশনের কাছে গত এপ্রিলে ছয় ব্যাংকের যে চিত্র তুলে ধরেছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, ছয় মাসের ব্যবধানে তা আরও খারাপ হয়েছে। যেমন ছয় মাস আগে বেসিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৫৮ শতাংশ, এখন তা ৬৩ শতাংশ। সোনালী ব্যাংকের এই হার অবশ্য ১৫ শতাংশ থেকে সামান্য কমে ১৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ হয়েছে। আইএমএফকে গতকাল তা জানানো হয়েছে। তারা জানায়, জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২৫ থেকে বেড়ে ৩৩ শতাংশ, অগ্রণীর ১৭ থেকে বেড়ে ২৪ শতাংশ, রূপালীর ১৭ থেকে বেড়ে ১৯ শতাংশ ও বিডিবিএলের ৩৬ থেকে বেড়ে ৪৪ শতাংশ হয়েছে।

আইএমএফ গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সময় শর্ত দেয়, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়ার সময়ও ছয় ব্যাংকের খেলাপির হার ছিল ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ। দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার আগে অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে তা বেড়ে ২৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

সূত্র জানায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আইএমএফকে জানায়, খেলাপি ও অবলোপন থেকে ভালো আদায় হচ্ছে না। আর খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখা যে বাধ্যতামূলক, তা রাখতে অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে। বেসিক ব্যাংক লোকসানে থাকলেও বাকি পাঁচ ব্যাংকের নিট মুনাফাও খুব সামান্য, অর্থাৎ দুই হাজার কোটি টাকার কম।

পরিস্থিতির উন্নতি কীভাবে হবে—আইএমএফের এমন প্রশ্নের গতানুগতিক জবাবই দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তারা জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএল ছাড়া রাষ্ট্রমালিকানাধীন অন্য পাঁচ ব্যাংকেরই সংঘ স্মারক (এমওইউ) রয়েছে। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে সবারই রয়েছে বার্ষিক কর্ম কৃতি চুক্তি (এপিএ)। বৈঠক সূত্র জানায়, এ দুইয়ের অর্জন ভালো নয় বলে আইএমএফ দলের কাছে মনে হয়েছে।

বৈঠক সূত্র বলেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ জানায় যে এখন দেশ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছে, অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কম। ডলার-সংকটে পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো এবং রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) দিয়ে সংকটের মোকাবিলা করা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কমাতে হবে—এ ব্যাপারে আইএমএফকে কেন বলতে হবে। এ তো আমাদের নিজেদেরই দায়িত্ব। কিন্তু আমরা উল্টো নীতি গ্রহণ করে ঋণগ্রহীতাদের এমন বার্তা দিচ্ছে যে তারা টাকা পরে দিচ্ছে। ৩০ শতাংশের পরিবর্তে মাত্র ২ শতাংশ টাকা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে গ্রাহকদের। খেলাপি ঋণ তো বাড়বেই!’

সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলোতে চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের নিয়োগ দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। অথচ তাঁদের কোনো জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না। তাঁদের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকও চুপচাপ থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের শক্তিশালী হওয়া এবং খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া ছাড়া অবস্থার উন্নতি হবে না, আইএমএফ বললেও কোনো লাভ হবে না।

আইন সংশোধনের কী হাল

আইএমএফ বাংলাদেশের পাঁচটি আইনের সংশোধন চায়, যা ঋণ কর্মসূচিতেও বলা আছে। গতকালের বৈঠকে আবারও তা জানতে চেয়েছে তারা। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ জানায়, ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩ হয়ে গেছে। বাকিগুলো সংশোধন হওয়ার পথে। এর মধ্যে ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন, ১৯৯৩ নতুন করে করা হচ্ছে। বাকি তিনটি আইন হলো হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১; দেউলিয়া আইন, ১৯৯৭ এবং অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে তারল্য সংরক্ষণ করে আসছে ব্যাংকগুলো। পুরো ব্যাংক খাতে তারল্য পরিস্থিতি ভালো থাকলেও ৯টি ব্যাংকে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ওই ৯ ব্যাংকের মধ্যে ৭টিই হচ্ছে ইসলামি ধারার, মানে শরিয়াহভিত্তিক। এ নিয়ে আইএমএফকে জানানো হয়, ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো থেকে আমানত সরিয়ে গ্রাহকেরা নিয়ে গেছেন প্রচলিত ধারার ব্যাংকে। ফলে ইসলামি ধারার এসব ব্যাংক ছয় মাস ধরে বড় ধরনের আমানত-সংকটে ভুগছে। আইএমএফ এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

ডলারের হিসাবে গরমিল

আইএমএফের দল গতকাল সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও বৈঠক করেছে। বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ বিদেশে থাকায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বৈঠকে যৌথভাবে নেতৃত্ব দেন দুই অতিরিক্ত সচিব নূর মো. মাহবুবুল হক ও মো. আবদুর রহিম খান।

আইএমএফের দিক থেকে জানতে চাওয়া হয়, বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে যে কোটি কোটি ডলার পড়ে আছে, সেগুলো আসছে না কেন।

সূত্র জানায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে ডলার আসছে না, তা নয়। ১৫০ কোটি ডলারের মতো একটা গরমিল আছে। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক একভাবে আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আরেকভাবে হিসাব করে। এনবিআর হিসাব করে এলসি নিষ্পত্তির পর। আর বাংলাদেশ ব্যাংক হিসাব করে পাওনা পরিশোধের পর। এতে তিন মাসের একটা পার্থক্য হয়ে যায়। এ পার্থক্য এক মাসে নামিয়ে আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে।