অর্থনীতিতে অংশীদার ৭: যুক্তরাজ্য
বাণিজ্যে এগিয়ে, পিছিয়ে বিনিয়োগ সম্ভাবনায়
যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। বাণিজ্যের ভারসাম্যও বাংলাদেশের পক্ষে।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে, সেখানে যুক্তরাজ্যের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তবে টেবিলের অন্য পাশ থেকে দেখলে চিত্রটা ততটা উজ্জ্বল নয়। কারণ, ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে বিনিয়োগ করেছে, তার মাত্র শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ এসেছে বাংলাদেশে।
ব্রিটেনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশের বড়সংখ্যক মানুষ সে দেশে বসবাস করেন। সে কারণেই বাংলাদেশে ব্রিটেনের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বিশ্লেষকদের কিছুটা হতাশই করে। তবে বাংলাদেশের বড় রপ্তানি বাজারের একটি যুক্তরাজ্য। প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আসে দেশটি থেকে, আসে বৈদেশিক আর্থিক সহায়তাও। বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশও পড়াশোনার জন্য প্রতিবছর দেশটিতে যায়।
ডিসিটিএস নিয়ে যদি কখনো কোনো ঝুঁকি তৈরি হয়, তাহলে সেটা এখানে হতে পারে। সে ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবেরিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টে চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের জোট এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়া—যুক্তরাজ্যে রপ্তানি নিয়ে এই দুই বড় দুশ্চিন্তা ছিল বাংলাদেশের সামনে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য যুক্তরাজ্য যে নতুন বাণিজ্য কর্মসূচি চালু করেছে, তা স্বস্তি এনেছে বাংলাদেশের জন্য। ‘ডেভেলপিং কান্ট্রিজ ট্রেডিং স্কিম (ডিসিটিএস)’ শীর্ষক এই কর্মসূচি চালু হয়েছে গত জুনে।
বড় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি
যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি ঘটে ২০২১-২২ অর্থবছরে। এর আগের অর্থবছরে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল ৩৭৫ কোটি ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৪৮৩ কোটি ডলার। ফলে দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য এখন বাংলাদেশের রপ্তানির তৃতীয় বৃহত্তম গন্তব্য। এ ধারা অব্যাহত ছিল গত ২০২২-২৩ অর্থবছরেও। ওই বছর যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় হয়েছে ৫৩১ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের রপ্তানির ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশের গন্তব্য ছিল যুক্তরাজ্য। দেশটিতে মোট রপ্তানির বেশির ভাগ, অর্থাৎ ৯০ শতাংশের বেশি পোশাকসহ বস্ত্র খাতের পণ্যের দখলে। এর বাইরে চিংড়ি ও বাইসাইকেলের মতো কিছু পণ্য রপ্তানি হয়।
যুক্তরাজ্যে রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণে সমস্যা কোথায়, জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশ যেসব পণ্য রপ্তানি করে, তার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের আমদানি চাহিদা কতটুকু মেলে, সে বিষয়টি এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করা দরকার। পোশাকের বাইরে অন্য যেসব পণ্যের চাহিদা সে দেশে রয়েছে, সেসব পণ্য তৈরি বা সেসব পণ্যে অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাংলাদেশের হয়তো কম।
আমদানি অনেক কম
রপ্তানির তুলনায় যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি বেশ কম। ব্রিটেনের ডিপার্টমেন্ট ফর বিজনেস অ্যান্ড ট্রেডের হিসাবে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ প্রায় ৯০ কোটি পাউন্ডের পণ্য যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি করেছিল। ২০২১ সালের তুলনায় সেখানেও অবশ্য বড় প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ। ওই বছর বাংলাদেশের আমদানি ছিল ৭০ কোটি পাউন্ড মূল্যের পণ্য। যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লোহা ও স্ক্র্যাপ, যন্ত্রপাতি, জেনারেটর, এয়ারক্র্যাফট ইত্যাদি।
ডিপার্টমেন্ট ফর বিজনেস অ্যান্ড ট্রেডের তথ্যানুসারে, যুক্তরাজ্য যেসব দেশে পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে, সেই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান বেশ নিচে, ৭৭তম। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে সেবাপণ্য রপ্তানিতে বড় প্রবৃদ্ধি ঘটে।
সার্বিকভাবে ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বাংলাদেশের পক্ষে ছিল। বাংলাদেশ এখন যুক্তরাজ্যের ৫১তম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার। তবে যুক্তরাজ্য তার মোট বাণিজ্যের মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ করে বাংলাদেশের সঙ্গে।
অন্যতম শীর্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারী
২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত দেশে বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি ছিল ২৮১ কোটি ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যুক্তরাজ্য অন্যতম শীর্ষ বিনিয়োগকারী হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সে দেশ থেকে খুব বেশি বিনিয়োগ আসছে না।
ব্রিটেনের অফিস অব ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকসের হিসাবে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের কোম্পানি বা ব্যক্তির বিনিয়োগ ১৪ শতাংশ বা ১০ কোটি পাউন্ড বেড়েছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্য থেকে বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৮০০ কোটি পাউন্ড। এ বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। মোট বিনিয়োগের মাত্র শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ পেয়েছে বাংলাদেশ। এ দেশে ব্রিটিশ কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ২০০। সম্ভাবনার তুলনায় বাংলাদেশ যে ব্রিটিশ বিনিয়োগ কম আকৃষ্ট করতে পারছে, গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংলাপে তা আলোচিত হয়।
দুই দেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ইউকে বাংলাদেশ ক্যাটালিস্টস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ইউকেবিসিসিআই) পরিচালক আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন কোম্পানি অনেক আগে থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে। এদের মধ্যে ইউনিলিভার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, এইচএসবিসি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া যেসব অনিবাসী বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যে বাস করেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছেন। তবে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর নতুন করে বিনিয়োগের জায়গা কম; কারণ, আমাদের যথেষ্ট স্থানীয় বাজার নেই।’
উন্নয়ন সহায়তা
স্বাধীনতার পর থেকে যেসব দেশ বাংলাদেশকে উন্নয়ন সহায়তা দিয়ে আসছে, তাদের একটি যুক্তরাজ্য। লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের তথ্যানুসারে, দেশটি বাংলাদেশকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কোটি পাউন্ড আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।
প্রবাসী আয়
যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যা বেশ উল্লেখযোগ্য। ২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ রয়েছে। এর বাইরে স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে বাস করেন আরও অনেক বাংলাদেশি। এ কারণে ব্রিটেন বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের অন্যতম উৎস। বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ে যুক্তরাজ্যের অবস্থান এখন তৃতীয়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে দেশটি থেকে প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় ৫৯ কোটি ডলার।
ডিসিটিএস-সম্ভাবনা এবং উদ্বেগ
যুক্তরাজ্য যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য ছিল, তখন সে দেশে রপ্তানি করতে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু ব্রেক্সিটের পর ব্রিটেন আর ইইউর সদস্য নয়। তবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য নতুন একটি বাণিজ্য সুবিধা চালু করেছে যুক্তরাজ্য। ডিসিটিএস নামের এই কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা পাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ বাণিজ্য সুবিধাকেই প্রতিস্থাপন করছে ডিসিটিএস কর্মসূচি।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টে (র্যাপিড) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, এলডিসি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তিন বছর পর পর্যন্ত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শূন্য শুল্কেই যুক্তরাজ্যের বাজারে ঢুকতে পারবে, তবে এরপর কিছুটা পরিবর্তন আসবে।
মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, ২০২৯ সালের পর তৈরি পোশাককে ‘ডাবল ট্রান্সফরমেশন’ বা দুই ধাপের উৎসবিধির শর্ত পরিপালন করতে হবে। এর অর্থ হলো, পোশাকের জন্য সুতা ও কাপড় দেশেই তৈরি করতে হবে। নিট পোশাকের ক্ষেত্রে এটি সমস্যা না হলেও ওভেন পোশাকের ক্ষেত্রে দেশে সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।
তবে ডিসিটিএসের আওতায় যুক্তরাজ্য চাইলে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ও পরিবেশসংক্রান্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করতে পারবে। মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ডিসিটিএস নিয়ে যদি কখনো কোনো ঝুঁকি তৈরি হয়, তাহলে সেটা এখানে হতে পারে। সে ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।’