ভর্তুকি কমানোর কৌশল তৈরির পরামর্শ দিল আইএমএফ

বাংলাদেশে বাজেটের আকারের তুলনায় ভর্তুকির পরিমাণ বেশি বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বহুজাতিক সংস্থাটি বলেছে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সারে ভর্তুকি কমানোর সুযোগ রয়েছে।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ করা হয় ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। আইএমএফ চায়, এ ভর্তুকি কমিয়ে ভবিষ্যতে একটা যৌক্তিক জায়গায় নিয়ে আসুক সরকার। সে জন্য কৌশল প্রণয়নের পাশাপাশি নীতি-পদক্ষেপ হাতে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।

আইএমএফের সফররত একটি প্রতিনিধিদল গতকাল বুধবার ঢাকায় সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে এমন পরামর্শ দেয়। বৈঠক সূত্রে এসব কথা জানা গেছে। আইএমএফের প্রতিনিধিদলটি গত সোমবার ঢাকায় আসে, পরদিন মঙ্গলবার থেকে বৈঠক করে চলেছে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেখার পাশাপাশি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার কত সময় ক্ষমতায় থাকবে এবং তারাই-বা এ সরকারের সঙ্গে কীভাবে কাজ করবে—এসব বুঝতে চাওয়াই আইএমএফ প্রতিনিধিদলের এবারের সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য।

গত দুই দিনে পাঁচটি বৈঠক করেছে প্রতিনিধিদলটি। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৈঠক চলবে। পাঁচ দিনে তারা ১৫টির বেশি বৈঠক করবে। প্রথম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার প্রমুখ।

গতকালের বৈঠকে যথাযথ ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ প্রকৃত উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছানোর বিষয়ে আলোচনা হয়। আইএমএফের প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশের কাছে জানতে চেয়েছে, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সারের ভর্তুকি বাবদ বকেয়া পরিস্থিতি কী এবং সেসব বকেয়া পরিশোধের পরিকল্পনাই-বা কী সরকারের।

ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় হাত দেওয়ার দরকার আছে। তবে কাজটা করতে হবে ধাপে ধাপে। এর আগে সার্বিক ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার একটা মূল্যায়ন দরকার। কোন খাতে কতটা ভর্তুকি কমালে কী প্রভাব পড়বে, তা যাচাই করতে হবে।
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ করা হয় ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ভাতাসহ বিভিন্ন খাতে এ টাকা ব্যবহার করা হয়। যদিও কিছু ক্ষেত্রে উপকারভোগীদের তালিকা তৈরি ও বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের প্রতিনিধিদল সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সম্প্রসারণ চায়।

বাংলাদেশকে চলমান ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচির অতিরিক্ত আরও ৩০০ কোটি ডলার দেবে আইএমএফ। এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে সংস্থাটির প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার গত ৫ আগস্ট বিদায় নেওয়ার পর ৮ আগস্ট গঠিত হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভার আগে বাড়তি ঋণ পেতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আইএমএফকে কোনো আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হবে না।

সূত্রগুলো জানায়, ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর একটি বাজেট শেষ হয়েছে। আরেকটি এখন চলমান। বাজেটের কর্ম কৃতি (পারফরম্যান্স) জানতে চেয়েছে আইএমএফের দল। বর্তমান সরকার ভবিষ্যতে কোন কোন খাতে অগ্রাধিকার দেবে, তারও খবর নিয়েছে তারা।

আইএমএফের প্রতিনিধিদল আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের সঙ্গে বৈঠক করবে। এতে রাজস্ব আয় সংগ্রহের মাত্রা, ব্যয় করার হার, দেশি-বিদেশি ঋণের পরিমাণ এবং ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা—এসব নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া আয়কর আইন এবং শুল্ক আইনের বাস্তবায়ন নিয়েও তারা আজ কথা বলবে বলে জানা গেছে।

মঙ্গলবার প্রথম দিনের বৈঠকের পর অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ব্যাংক খাত সংস্কারের পাশাপাশি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ, কর ব্যবস্থাপনা, আয়কর ও ভ্যাট সংস্কারের জন্য কারিগরি সহায়তা চাওয়া হয়েছে আইএমএফের কাছে।

জানতে চাইলে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় হাত দেওয়ার দরকার আছে। তবে কাজটা করতে হবে ধাপে ধাপে। এর আগে সার্বিক ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার একটা মূল্যায়ন দরকার। কোন খাতে কতটা ভর্তুকি কমালে কী প্রভাব পড়বে, তা যাচাই করতে হবে।

সামাজিক নিরাপত্তা খাত নিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, ‘এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। একদিকে প্রকৃত উপকারভোগী যেমন চিহ্নিত করতে হবে, আরেকদিকে ভুয়া উপকারভোগী বাদ দিতে হবে। এ নিয়ে আমরা বহু বছর ধরেই কথা বলে আসছি। দেখা যাক, এখন কী হয়।’